১৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলাকে গড়তে যারা তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন এমন একজন মহামানবের আজ শাহদাতবার্ষিকী। পাবনার মাওলানা আবদুস সুবহান এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ইতিহাস। ১৯৬২ সাল থেকে এ জনপদের জনগণ তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছেন, যা পাবনার অন্য কোন নেতার ক্ষেত্রে হয়নি।
তাঁর জীবনের মিশনই ছিল জনকল্যানমূলক কাজ; শিক্ষা, সেবা ও বৃত্তিমূলক কাজের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এলাকার জনসাধারনকে শিক্ষিত করে তোলা এবং বেকারত্ব দূর করা।
এমন একজন জনপ্রিয় আলেমে দ্বীনকে সহ্য করতে পারেনি কোনো স্বৈরাচারী সরকার। আইয়ুব, শেখ মুজিব, হাসিনা প্রতিটি মাফিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন। বিনিময়ে ভয়ংকর নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দীর্ঘদিন হাসিনা তাঁকে বন্দি রেখে, বিনা চিকিৎসায় অত্যন্ত নির্দয়ভাবে পাবনার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাকে ২০২০ সালে খুন করেছে।
জন্ম ও শৈশব
মাওলানা আবদুস সুবহান ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাবনা জেলার সুজানগর থানার তৈলকুন্ডু (বর্তমান মমিনপারা) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মৌলবী নাঈম উদ্দিন আহমেদ একজন দ্বীনদার পরহেজগার আলেম ছিলেন। ১৯৬৫ সাল থেকে পাবনা শহরের গোপালপুর (পাথরতলা) স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তারা। বর্তমানে তাঁর পরিবার-পরিজন সেখানেই বসবাস করছে।
শিক্ষা জীবন
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় সুজানগরের রামচন্দ্রপুর মক্তবে পরে তিনি মানিকহাট ও মাছপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন ১৯৪১ সালে তিনি উলাট মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং প্রায় সাত বছর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে ১৯৪৭ সালের জুনিয়র পাস করেন তিনি শিবপুর মাদ্রাসা থেকে। ১৯৫০ সালে আলিম পাস করেন তিনি সিরাজগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে, ১৯৫২ সালে ফাজিল, ১৯৫৪ সালে কামিল পাস করেন। মাওলানা আবদুস সোবহান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি জুনিয়র মেট্রিকুলেশন আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। কামিল পরীক্ষায় মাদ্রাসা বোর্ড থেকে হাদিস গ্রুপে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
কর্মজীবন
মাদ্রাসা বোর্ড থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১৯৫২ সালে হেড মাওলানা হিসাবে পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় যোগদান করেন অতঃপর তিনি গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউট আরিফপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় সুপারিনটেনডেন্ট ও মাগুরা জেলার বররিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। সবশেষে তিনি আরিফপুর ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি টেনে সক্রিয় রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
মাওলানা আবদুস সুবহান ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার পাবনা জেলার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন পাবনা জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। পরে নিখিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কর্মপরিষদ ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন।
তিনি ১৯৬১ সালে গয়েশপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হন ১৯৬২ সালে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, ১৯৬৫ সালে তিনি পুনরায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দলের সিনিয়র ডেপুটি লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে বিপুল ভোটে পাবনা সদর আসনের এমপি নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম সর্বোচ্চ ভোটে জয়লাভ করেন এবং সংসদে জামায়াতে ইসলামের উপনেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে আবারো এমপি নির্বাচিত হন। মাওলানা আদুস সোবহান ২০০১-০৬ মেয়াদে সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
সামাজিক কর্মকাণ্ড
ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা আবদুস সোবহান সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৬ সালে তিনি আঞ্জুমানে রফিকুল ইসলাম নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ১৯৬৮ সালে তিনি জালালপুর জুনিয়ার হাই স্কুল ও বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ নামের প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। মাওলানা আবদুস সুবহানের আরো একটি বড় অবদান হচ্ছে পাবনা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল। ১৯৬৭ সালে পাবনার জালালপুরে তিনি এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানে স্কুলটি পাবনা ক্যাডেট কলেজে উন্নীত হয়েছে। তিনি পাবনা দারুল আমান ট্রাস্ট এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এই ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত পাবনা ইসলামিয়া মাদ্রাসা ইসলামিয়া এতিমখানা ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজ ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার হেফজখানার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
ইমাম গাজ্জালী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, কিন্ডার গার্ডেন স্কুল কলেজ, আল-কোরআন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি পাবনা সদর গোরস্থান কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পাবনা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহ-সভাপতি ছিলেন। উল্লেখ্য তিনি নিজের জমি লিখে দিয়ে পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ। এই কলেজের আগের নাম ছিল ইসলামিয়া কলেজ। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব এই কলেজের নাম পরিবর্তন করে। শেখ মুজিব এভাবে সকল প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করেন যেগুলোর নামে ইসলাম বা মুসলিম ছিল।
এছাড়াও মাওলানা আবদুস সুবহান সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ এবং ঈশ্বরদি সরকারি কলেজ (প্রাক্তন জিন্নাহ কলেজ)সহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ হাতে গড়েছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পাবনার অসংখ্য রাস্তা-ঘাট ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ করে তিনি পাবনার মানুষের কষ্ট লাঘব করেছেন। তার গড়া দারুল আমান ট্রাস্ট বর্তমান শিক্ষা নগরী হিসেবে পরিচিত, সেখানে তার ব্যক্তিগত প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মসজিদে তাকওয়া নামে একটি অত্যাধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
পাবনা ক্যালিকো কটন মিল তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও তিনি বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। তিনি এলাকার রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়নের কাজ করেছেন। পাবনা ক্যাডেট কলেজ হতে গয়েশপুরের রাস্তা, কালিদহ হতে ভাঁড়ারা রাস্তা, কুচিয়ামোড়ার তেমাথা হতে সাদুল্লাপুর রাস্তা, ৮ মাইল হয়ে টিকরী-দাপুনিয়া রাস্তা তাঁর কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর বহন করে। মাওলানা আদুস সুবহান পুরাতন পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কোমরপুর পদ্মা নদীর তীর পর্যন্ত রাস্তা পাকা করেছেন, যা পাবনার চর এলাকার মানুষের কাছে একসময় ছিল কল্পনাতীত।
বাংলাদেশ চাষিকল্যাণ সমিতি ও বাংলাদেশ তাঁতি কল্যাণ সমিতির তিনি সহ সভাপতি ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তিনি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি পাবনা মহিলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। মাওলানা আদুস সুবহান ঢাকাস্থ পাবনা সমিতির আজীবন সদস্য, ইত্তেহাদুল উম্মাহর প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তিনি মুসলিম এইড লন্ডন এর বাংলাদেশ শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ইসলামিক ‘ল’ রিসার্চ সেন্টার এবং লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ-এরও চেয়ারম্যন ছিলেন। তিনি জাতীয় শরীয়াহ কাউন্সিলের সদস্য এবং আল আমান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, ত্রৈমাসিক গবেষণা পত্রিকা ইসলামী আইন ও প্রচার পত্রিকার তিনি উপদেষ্টা সম্পাদক।
লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
একজন সুলেখক হিসেবেও মাওলানা আব্দুস সুবহানের পরিচিতি রয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি চিন্তাশীল প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। একসময় তিনি সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিলেন। মাওলানা আদুস সুবহান বাংলা ছাড়াও আরবী, উর্দু, ফার্সি, ইংরেজি সহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। একজন সংস্কৃতিপ্রেমী ও সংস্কৃতিসেবী হিসেবেও মাওলানা আব্দুস সুবহানের সুনাম রয়েছে। ছাত্রজীবনে তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় ছিলেন। গান ও বক্তৃতা প্রতিযোগীতায় পুরস্কারও পেয়েছেন বহুবার।
মাওলানা আদুস সুবহানেবর কৃতিত্ব বলে শেষ করার মত নয়। তিনি আওয়ামী মাফিয়া সরকারের তথাকথিত মানবতা বিরোধী মামলায় ফাঁসীর রায়ে দণ্ডিত হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে আবদ্ধ থেকেও তিনি কল্যাণময় কাজে পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি তার সম্পত্তির একটি বড় অংশ বিক্রয় করে পাবনার প্রাণকেন্দ্র দারুল আমান ট্রাস্ট তথা ইসলামিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এতে প্রায় ৩ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। মসজিদটিতে একসাথে প্রায় ৩ হাজার নামাজি নামাজ আদায় করতে পারেন।
শুধু তাই নয় মাওলানা সাহেবকে কারাগারের মধ্যে যে ভাইটি সেবা যত্ন করতেন তার ব্যাপারে তিনি সন্তানদের কাছে অসিয়ত করে গেলেন – মামুন নামের ছেলেটি কারাগার থেকে বের হলে আমি জীবিত থাকি আর মারা যাই তোমরা আমার সম্পত্তি বিক্রি করে ছেলেটিকে ওমরা হজ্জ পালন করার ব্যাবস্থা করে দিবে।
শাহাদাত
মাওলানা আবদুস সুবহানকে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে ঢাকা থেকে পাবনা যাওয়ার পথে যমুনা সেতু এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে জালিম হাসিনা সরকার। এরপর তথাকথিত মানবতাবিরোধী মামলায় দীর্ঘদিন জালিম সরকারের মিথ্যা রায়ে কারাগারে আবদ্ধ থেকেছেন। প্রবীণ এই জিন্দাদিল মুজাহিদ কখনো জালিমের কাছে মাথানত করেননি। ফলস্বরুপ প্রতিটি জালিম আইয়ুব, শেখ মুজিব ও হাসিনা তাকে জুলুম নির্যাতনের মুখোমুখি করে। তিনি প্রতিটি মাফিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন। বিনিময়ে ভয়ংকর নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শেখ হাসিনা এই অসুস্থ নেতাকে চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাও করেননি। অবশেষে তিনি যখন মৃত্যুমুখে পতিত হন তখন তাঁকে বেড়ি ও হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালে এনে চিকিৎসার নামে আর বেশি নির্যাতন শুরু করে।
অবশেষে হাজারও ঈমানী পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মহান রবের মন জয় করে সেই রবের সাথে সাক্ষাতের জন্য দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। জালিমদের আল্লাহ তায়ালা সর্বোচ্চ সুযোগ দেন। ছাড় দেন তবে অবশ্যই ছেড়ে দেন না। ইনশাআল্লাহ হাসিনা ও তার মাফিয়া গ্যাং অবশ্যই ফেরাউনের পরিণতি বরণ করবে।