জীবনী : শহীদ মাওলানা এ কে এম ইউসুফ

শহীদ মাওলানা এ কে এম ইউসুফ ছিলেন একাধারে স্বনামধন্য মুহাদ্দিস, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও মুহাক্কিক। তিনি একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। তিনি তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন এদেশের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি চাষী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষের খেদমত করে গেছেন। তার এই সমাজসেবামূলক কর্মের মাধ্যমে অমুসলিমরাও উপকৃত হয়েছেন। তিনি বলেন, জুলুমবাজ সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের জন্য কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে তাকে কারারুদ্ধ করে তিলে তিলি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

জন্ম :
১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাগেরহাটের শরণখোলায় মা-বাবার ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। আবার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ৮৭ বছর বয়সে আরেক ফেব্রুয়ারি মাসে। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে বেলা এগারোটা তিরিশ মিনিটে রাজধানীর পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়।

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার :
মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলা শরণখোলার বাসিন্দা। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা তার গ্রামের স্কুল এবং পরে রায়েন্দার একটি স্কুল থেকে সম্পন্ন করেন। তিনি শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা শেষ করেন।

শহীদ এ কে এম ইউসুফ ফাজিল এবং কামিল পড়াশোনা করেন ঢাকা আলিয়া থেকে। ১৯৫০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে ফাজিল (সম্মান) পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে দেশে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপরেই তিনি ১৯৫২ সালে স্নাতক (কামিল) পরীক্ষা শেষ করেন, মমতাজ আল-মুহাদ্দেসিন হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করেন, দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামের পন্ডিতদের কাছে এটি সর্বোচ্চ সুনাম ।

তিনি ১৯৫২ সালে মাদ্রাসা শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৫৮ সালে খুলনা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হন। তিনি মথবাড়িয়ার (বরিশাল) একটি সিনিয়র মাদ্রাসায়ও শিক্ষকতা করেছিলেন, যেখানে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নয় বরং উপমহাদেশের অন্যতম হাদীস বিশারদ। হাদীসের মশহুর কিতাব “হাদীসের আলোকে মানব জীবন” তাঁর অনন্য কীর্তি। বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ অথচ জীবনঘনিষ্ঠ হাদীসসমূহ এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্ত প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা সন্নিবেশিত করে তিনি যে অনন্য সাধারণ হাদীস গ্রন্থ সংকলন করেছেন- এই একটি মাত্র কারণেই তিনি আমাদেরকে ঋণী করে গিয়েছেন অনাগত কালের জন্য।

পারিবারিক জীবন :
মাওলানা এ কে এম ইউসুফ ১৯৪৯ সালে রাবেয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে আছে ৩ ছেলে ৫ মেয়ে। সন্তানরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত।

ইসলামী আন্দোলনে যোগদান :
শহীদ আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ ১৯৫২ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তাঁর জামায়াতে যোগদানের মূল কারণ ছিলো আরেক মুমতাজুল মুহাদ্দেসীন মাওলানা আব্দুর রহীম। তাছাড়া তিনি মাওলানা মওদূদীর লেখার ভক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি জামায়াতের খুলনা বিভাগের আমীর ছিলেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খানের দ্বারা পাকিস্তানে সামরিক আইন ঘোষণার পরে সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরে শহীদ ইউসুফ জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের নায়েব-ই-আমীর (সহসভাপতি) পদে নিযুক্ত হন।

একাত্তরের পরে, একেএম ইউসুফ জামায়াতের সিনিয়র নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছিলেন। আমীর মাওলানা আবদুর রহিমের অধীনে তিনি এক মেয়াদে সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। তিনি আবারও একই দায়িত্বে জামায়াত আমীর গোলাম আযমের সাথে টানা তিনবার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সাথে তিনি বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েব-আমির হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্বে অব্যাহত ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন :
১৯৬২ সালের নির্বাচনে মাওলানা এ কে এম ইউসুফ নির্বাচনী এলাকা খুলনা ও বরিশালের প্রার্থী হওয়ার জন্য জামায়াত থেকে মনোনীত হয়েছিলেন। আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা থেকে ছুটি নিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হন। ৩৫ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন।

তিনি ১৯৬০-এর দশকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে তিনি মালেক মন্ত্রীসভার একজন মন্ত্রী ছিলেন।

অন্যান্য সামাজিক কাজ
জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্ব পালন ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শহীদ এ কে এম ইউসুফ শরীয়াহ কাউন্সিল, দারুল আরাবিয়া, কেন্দ্রীয় ওলামা-মাশায়েখ কমিটি প্রভৃতি সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য সামাজিক কাজ হলো চাষী কল্যাণ সমিতি। তিনি ছিলেন এদেশের লক্ষ লক্ষ চাষিদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ চাষি কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি। এদেশের গ্রামীণ জনপদের চাষিদের সংগঠিত করা, তাদের মাঝে আদর্শিক চেতনা জাগ্রত করা, তাদের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়া এইসব লক্ষ্য নিয়ে তিনি চাষী কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান আমল থেকে বাগেরহাট ও খুলনায় অসংখ্য ইয়াতিমখানা, স্কুল, মাদরাসা ও মসজিদ স্থাপন করেন।

অসিয়ত
২০১৩ সালের ৪ মে তিনি তাঁর সন্তান, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে অসিয়ত করে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“আমার বয়স এখন ৮৭ বছরে উপনীত হয়েছে। আমার সমবয়সী সাথী ও বন্ধুদের অধিকাংশই এখন দুনিয়া ত্যাগ করে পরপারের যাত্রী। যেহেতু আমার বয়স অধিক; উপরন্তু আমি নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত যে কোন সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে পরপারের আহ্বান আসতে পারে।

আমি পরম করুণাময় আল্লাহর একজন ক্ষুদ্র বান্দা ও দাস। মহান রাব্বুল আলামীন আমার নিজের ও সন্তান-সন্ততি ও নাতী-নাতনীদের ওপরে করুণার যে ধারা প্রবাহিত রেখেছেন, আমার কামনার চেয়ে তা অনেক অধিক, যার শুকরিয়া আদায় করা আমার সাধ্যের অতীত।

আমি আমার সন্তান ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, দেশ ও দেশের বাইরে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য যারা কাজ করেছেন, আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা নিয়ে আমি তাদের কাতারে শামিল ছিলাম। পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপরে অনুগ্রহ ছিল, ফলে আমি দেশ-বিদেশের কতিপয় নেক বান্দাহ ও দাতা সংস্থার সাহায্যে আমার মাতৃভূমির সব এলাকায় বেশ কিছু সদকায়ে জারিয়াহর কাজ করেছি।

আমি আমার সন্তান ও শুভাকাংখীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, তোমরা তোমাদের পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনদের অধিকারের ব্যাপারে যেমন সতর্ক থাকবে। তেমনি সতর্ক থাকবে প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের অধিকারের ব্যাপারেও। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের কথাটাও যেনো তোমাদের চিন্তায় থাকে।

সাধ্যের মধ্যে থেকে তোমরাও সবসময় সদকায়ে জারিয়াহর কাজ করবে। কেননা সদকায়ে জারিয়াহর সওয়াব মৃত্যুর পরেও আমলনামায় জমা হতে থাকে। তোমরা আল্লাহ তা’আলার নির্দেশিত ফরজ ইবাদতসমূহ যেমন নামাজ, রোজা, জকাত ও হজ্জ আদায়ের ব্যাপারে আদৌ গাফলতি করবেনা। গুনাহের কাজের ধারে কাছেও যাবে না। আর নিয়তই নৈতিক চরিত্রের উঁচুমানে পৌছার জন্য সচেষ্ট থাকবে।

ওপরে যে অসিয়ত আমি আমার সন্তান-সন্ততিদের উদ্দেশ্যে করলাম, ঐ একই অছিয়ত আমার আন্দোলনের সাথী প্রবীণ ও তরুণদের জন্যও রইল।”

সাহিত্য :
মাওলানা এ কে এম ইউসুফ একজন সুপরিচিত আলেম এবং কোরআন অধ্যয়ন ও হাদিস সম্পর্কিত শিরোনাম সহ বেশ কয়েকটি বহুল পঠিত বই লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন কি এবং কেন?, হাদীসের আলোকে মানব জীবন, দর্পন, দেশ হতে দেশান্তরে, কুরআন হাদীসের আলোকে জিহাদ, জামায়াতে ইসলামী বিরোধীতার অন্তরালে।

শাহদাত :
ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্দ করে দিতে মরিয়া পাশের দেশের মুশরিকরা ও তাদের পদলেহনকারী স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার। এরই অংশ হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। কাল্পনিক সব অভিযোগ আনে দেশের সবচেয়ে উত্তম মানুষগুলোর প্রতি। এর মধ্যে পাঁচজন নেতাকে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করে। শহীদ এ কে এম ইউসুফ ছিলে অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অনেক রোগের রোগী। তাঁকে বিনা চিকিৎসায় কারাগারে আটকে রাখা হয়। তিনি স্ট্রোক করার পরও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। চিকিৎসা না দিয়ে তাঁকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। মুমতাজ আল মুহাদ্দিসীন নিজের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামের উপর টিকে ছিলেন। কোনো আপোষ করেননি সরকারের সাথে। ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তিনি শাহদাতের নজরানা পেশ করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শাহদাতের মর্যাদা দান করুন।