জীবনী : আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম, জাতির উত্থান-পতন, প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে জনাব মুজাহিদ একটি অকুতোভয় নাম। তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী চেতনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। বাংলার জমিনে নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রক্তচক্ষু মোকাবিলা করে তৃণমুল থেকে গড়ে উঠে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণপুরুষ। হাসিনা সরকার শুধুমাত্র আদর্শিক কারণেই ইসলামী আন্দোলনের এই জনপ্রিয় নেতাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার পাঁয়তারা করছে। কিন্তু শহীদদের দুনিয়া থেকে সরানো যায় না। তাঁরা জীবিত। তাদের মরণ নাই। মানুষকে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা দেবার জন্যই জন্ম।

ব্যক্তি জীবনে অল্পে তুষ্ট, নির্লোভ, পরোপকারী, দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী জননেতা মোহাম্মদ মুজাহিদ খুব অল্প সময়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই জনপদের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। নিজের কর্ম তৎপরতায় সদা তৎপর তিনি। তিনি মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার রায় শুনে আইনজীবীদের কাছে বললেন- ‘সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শাস্তির জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই। আমি পত্রিকার মাধ্যমে অবহিত হয়েছি যে, আপিল বিভাগে আমার পক্ষে আইনজীবীরা যথেষ্ট বলিষ্ঠভাবে এবং দৃঢ়তার সাথে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঐসব মিথ্যা অভিযোগে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপক্ষ আমার বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে জেরার সময় স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের কোথাও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত কোনো অপরাধের সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। এমনকি আমি আদৌ আল বদর, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল শামস বা এই ধরনের কোনো সহযোগী বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম এমন কোনো তথ্য তিনি তার তদন্তকালে পাননি। এর পরও আমার মৃত্যুদণ্ড বহাল। আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

আমি আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বলছি, আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে কোন ধরনের অপরাধের সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে এত বছর পরে আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ সাজানো হয়েছে।

প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত লোক স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর সাথে ফাঁসির আদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। কখন, কার, কিভাবে মৃত্যু হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেন। আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সাধ্য কারো নেই। সুতরাং ফাঁসির আদেশে কিছু যায় আসে না। আমি মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার ঘোষণায় উদ্বিগ্ন নই।
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে তার জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই। আমি আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্যে আমার জীবন কুরবান করার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি।’

শিক্ষা: আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি। তিনি তার পিতা, প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল আলীর কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। একজন ধর্মীয় নেতা ও আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসেবে মাওলানা আব্দুল আলীকে আজও ফরিদপুরসহ গোটা অঞ্চলের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তিনি শুধু ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না বরং জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পরবর্তীতে, জনাব আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে ভর্তি হন এবং তারও পরে তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়ন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা সুসম্পন্ন করার পর তিনি ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী শেষ করার পর তিনি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আগমন করেন। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাত্র দুই-আড়াই মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ক্লাস করার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় জনাব মুজাহিদ আর সেখানে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।

ছাত্র রাজনীতি: ছাত্র জীবন থেকেই জনাব মুজাহিদ রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। শুরুতে রাজেন্দ্র কলেজে কিছুদিন এনএসএফ এ কাজ করার পর তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে যখন তিনি ফরিদপুর ছাড়েন তখন তিনি ফরিদপুর জেলায় ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭১ সালের জুলাইতে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সেক্রেটারি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মনোনীত হন এবং এর মাত্র দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন।

জামায়াতে যোগদান: ছাত্রজীবন শেষ করার পরপরই আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮২-১৯৮৯ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

প্রাথমিক কর্মজীবন: জনাব আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তার পেশাগত জীবন শুরু করেন নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে। এর আগে ১৯৭৩-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। স্কুলের জন্য আর্থিক সংস্থান ও ছাত্র সংগ্রহে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার ঐকান্তিক চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কারণে আদর্শ স্কুল আজও নারায়ণগঞ্জ জেলায় সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জের আদর্শ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে সাংগঠনিক প্রয়োজনে তিনি ঢাকায় স্থানান্তরিত হন। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামের চেয়ারম্যান এবং সাপ্তাহিক সোনার বাংলার পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। গ্রেফতার হওয়ার কিছু দিন পূর্বে তিনি ’রাইজিং সান’ নামক একটি ইংরেজি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। পত্রিকাটির ডামি ভার্সন তখন প্রকাশিত হচ্ছিল। জনাব মুজাহিদ গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় পত্রিকাটি আজও আলোর মুখ দেখেনি।

জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা: আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বরাবরই দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, ১৯৯৪-১৯৯৬ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, ২০০০ সালে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনে এবং ২০০৭ সালে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর পাশাপাশি, জনগনের মৌলিক সমস্যা ও জাতীয় সমস্যা নিরসনেও তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন।

মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন: আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রী হিসেবে সফলতার সাথে ৫ বছরের মেয়াদ সম্পন্ন করেন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন তিনি নিন্মোক্ত সরকারি কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমিটিগুলো হচ্ছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ, নির্বাহী কমিটি-জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক), জাতীয় নারী উন্নয়ন কাউন্সিল, অর্থনীতি সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি, নারী উন্নয়ন এবং নারী অধিকার বিষয়ক জাতীয় কমিটি, কারা সংস্কার কমিটি, এসিড ও মাদক নিয়ন্ত্রন জাতীয় কমিটি, ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি, বয়স্ক ভাতা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং কিশোর অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন সময়ে তিনি মাদারীপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

সামাজিক কার্যক্রম: নিঃস্বার্থ একজন সমাজ সেবক হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দেশজুড়ে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ ও এতিমখানা বিনির্মাণে তার সক্রিয় ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তার নিজ জেলা ফরিদপুরে তিনি ৫০ টিরও বেশি মসজিদ নির্মাণে ভূমিকা পালন করেন। দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি এই ব্যাপক সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মাদ্রাসা ছাত্রদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে ২০০২ সালে তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকার ফাজিলকে বিএ সমমানের এবং কামিলকে মাস্টার্স মানে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণেও তার ভূমিকা সক্রিয় ছিল। তার প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে ফরিদপুর ও মাদারীপুরের মত অবহেলিত জেলা দুটিতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হয়। অগণিত রাস্তা, সড়ক ও মহাসড়ক, মাদরাসা, ব্রীজ, কালভার্ট ও মসজিদ এই সময় এই এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়। তিনি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় বিভাগীয় সমাজ সেবা কেন্দ্র এবং হাজী শরীয়তউল্লাহ ব্রীজ উদ্বোধন করেন।

মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে জনাব মুজাহিদ দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবেই তার মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সারপ্রাইজ ভিজিটে যেতেন। এর মাধ্যমে তিনি মন্ত্রণালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কমানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাতে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছেন। তার মেয়াদে তিনি বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শিশু সদন (সরকারি এতিমখানা) নির্মাণ করেন। যা সমাজের ভাগ্যহত ও অনগ্রসর কিশোর কিশোরীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে ব্যপকভাবে সাহায্য করে।

২০০১ সালে যখন জনাব আলী আহসান মো: মুজাহিদ সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তখন তা একটি দুর্বল বা লো প্রোফাইল মিনিস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু তার ৫ বছরের মেয়াদের শেষে এটি হাই প্রোফাইল তথা আলোচিত মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়। মন্ত্রণালয়ের বাজেট মাত্র ৫ বছরে ৫ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। এগুলো সবই হয় মন্ত্রী হিসেবে তার একনিষ্ঠ ও সফলতার কারণে।

তিনি তার মন্ত্রিত্বের ৫ বছরে ছোট খাট নানা অনুষ্ঠান ছাড়াও ৪০টিরও বেশি আলোচিত প্রোগ্রাম করেন যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যোগ দেন। তার নেতৃত্বে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রতিবন্ধী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ’মুক্তা’ নামক একটি মিনারেল ওয়াটারেরও প্রবর্তন করেন। যা প্রতিবন্ধীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত এবং বাজারজাতকৃত। তার এই উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের নাম তখন বিশ্ব দরবারে ভিন্নভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। তার সময় প্রতিবন্ধী অলিম্পিকেও বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করে। এছাড়া সুদ মুক্ত ঋণ ও এসিডদগ্ধদের মধ্যে ব্যপকভাবে ভাতা প্রদান করা হয় তার সময়ে। জনাব মুজাহিদ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে নিজে এই ভাতা বিতরণ করতেন। তাই তার সময়ে গ্রামের অভাবী মানুষ সুদখোর মহাজন এবং বেসরকারি সংস্থার হাত থেকে মুক্ত হয়ে সরকারের কাছ থেকে বিশেষত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে ঋণ নিতে শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে এই উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো বন্ধ হয়ে যায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে।

প্রকাশনা: আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একজন জনপ্রিয় এবং স্বনামধন্য লেখক। তার ৩টি বই ভীষণভাবে পাঠক সমাদৃত হয়। বইগুলো হলো, আজকের মুসলমান: ইসলামের দাবী, বিশ্বব্যপী ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামী এবং তুরস্ক সফর। জনাব মুজাহিদ ইসলামী শিক্ষা, আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুর উপরও নিয়মিতভাবে লেখালেখি করেছেন।

ভ্রমণ: জনাব মুজাহিদ ২০টিরও বেশি দেশে ভ্রমণ করেছেন। এই সব দেশে তিনি গণ্যমান্য, প্রভাবশালী এবং ইসলামী নেতৃবৃন্দের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তার ভ্রমণকৃত উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমীরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, জাপান,থাইল্যান্ড এবং তুরস্ক।

বৈবাহিক অবস্থা: আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর বেগম তামান্না-ই-জাহানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তামান্না-ই-জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগরী মহিলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তামান্না-ই-জাহান একজন গৃহিণী এবং পড়ুয়া মানসিকতার একজন নারী যিনি নিয়মিতভাবে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। জনাব মুজাহিদ ৩ পুত্র ও এক মেয়ে সন্তানের জনক।

শহীদ মুজাহিদের শেষ কথাঃ আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া। জেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ যে তারা এই সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন। জেল কর্তৃপক্ষ আসলে অসহায়। তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এই পর্যন্ত আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছেন এবং আমার সাথে ভাল ব্যবহার করেছেন। তারা আমাকে একটি লিখিত আবেদনের জন্য যথেষ্ট পীড়াপীড়ি করেন এবং বলেন এটা না হলে তাদের অসুবিধা হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে তারা বলেন, আপনার যা বক্তব্য আছে তাই লিখে দেন। আর সেই কারনেই এটা বলার পর আমি কনসিকুয়েন্স বুঝেও আমি তাদের সুবিধার জন্য একটি লিখিত আবেদন দিয়েছি।

আমি রাষ্ট্রপতিকে লিখেছি, আইসিটি এ্যাক্ট, যদিও এটা অবৈধ ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তারপরও এই বিচারের সময় আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সীমিত সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন, সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য ছিলনা। সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

আমাকে ট্রাইবুনাল ৬ নং চার্জে মৃত্যুদন্ড দেয়নি। তারা চার্জ ১ কে চার্জ ৬ এর সাথে মিলিয়ে চার্জ ৬ এ মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। আপীল বিভাগ আমাকে চার্জ ১ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। চার্জ ৬ এ তারা আমার মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছে। অথচ ট্রাইবুনাল শুধু চার্জ ৬ এর জন্য আমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়নি।

এই চার্জে স্বাক্ষী মাত্র একজন। সে বলেনি, যে কোন বুদ্ধিজীবিকে আমি হত্যা করেছি। কোন বুদ্ধিজীবি পরিবারের সন্তানও এসে বলতে পারেনি যে আমি কোন বুদ্ধিজীবিকে মেরেছি। এবং কোন বুদ্ধিজীবি পরিবারও আমার রায়ের পরও দাবী করেনি যে তারা তার পিতা হত্যার বিচার পেয়েছেন। আমার অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে যে আমি নাকি আর্মী অফিসারদের সাথে বসে পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু যে স্বাক্ষী এসেছে সেও বলেনি যে আমি কবে কোন আর্মি অফিসারের সাথে কোথায় বসে এই পরামর্শ করলাম?

সাক্ষী বলেছে আমাকে, নিজামী সাহেব ও অধ্যাপক গোলাম আযমকে দেখেছে। সে আমাদের চিনতো না। পরে আমাদের নাম শুনেছে। অথচ এই অভিযোগটি গোলাম আযমের সাহেবের বিরুদ্ধে আনাই হয়নি। নিজামী ভাইকে যাবজ্জীবন দিয়ে শুধু আমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে আমার মৃত্যুদন্ডের রায় কনফার্ম করে তারপর আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন শুরু করা হয়েছে।

আমাকে আমার পরিবার, সংগঠন ও দেশবাসীর কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, কাপুরুষ প্রমান করার জন্য দিনভর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই মিথ্যাচারের নাটক করা হয়েছে। এই জালিম সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আমি নির্দোষ, নির্দোষ এবং নির্দোষ। আমাদের আজ তারা অন্যায় ভাবে হত্যা করতে যাচ্ছে।

কত বড় স্পর্ধা তাদের যে তারা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করার দাবী করে। অথচ তাদের নিজেদের ভেতর মানবতা নেই। তারা ঘুমন্ত অবস্থায় একজন মানুষকে মধ্যরাতে তুলে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে বলে এই তাদের শেষ সাক্ষাত এবং এরপরও তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

তোমরা শুনে রাখো, আজ যদি আমার ফাঁসি কার্যকর করা হয় তাহলে তা হবে ঠান্ডা মাথায় একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। তোমরা প্রতিহিংসাপরায়ন হবানা। তোমাদের কিছুই করতে হবেনা। আজ আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর এই অন্যায় বিচারিক প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার আল্লাহর দরবারে শুরু হয়ে যাবে, বিচার শুরু হয়ে গেছে। তোমাদের কারও কিছু করতে হবেনা।

আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত এত বড় নেয়ামত দুনিয়াতে আর একটিও নেই। আমার জানামতে এই সংগঠন দুটি পৃথিবীর মধ্যে সেরা সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যপারে আমি সন্তুষ্ট। গত কয়েক বছরে অনেক নেতাকর্মী শহীদ হয়েছে, হাজার হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন, আমার মত জেলখানায় আছে কয়েক হাজার মানুষ। বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত ৫ বছরে যে ভুমিকা রেখেছে, যে স্যাক্রিফাইস করেছে তা অতুলনীয়। আমার শাহাদাত এই দেশে ইসলামী আন্দোলনকে সহস্রগুন বেগবান করবে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।

তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যারা স্বাক্ষী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুইজন ছাড়া বাকি সবাই দরিদ্র। তারা মূলত অভাবের তাড়নায় এবং বিপদে পড়ে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তাদের সবাইকে মাফ করে দিলাম, তোমরাও কোন ক্ষোভ রাখবা না।

পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেনঃ তোমরা নামাজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস থাকবা। তোমরা সব সময় হালাল রুজির উপর থাকবা। কষ্ট হলেও হালাল রুজির উপর থাকবা। আমি ৫ বছর মন্ত্রী ছিলাম, ফুল কেবিনেট মন্ত্রী ছিলাম। আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর রহমতে আমি সেখানে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে, পরিশ্রম করে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ আমার ব্যপারে বলতে পারবেনা যে আমি অন্যায় করেছি। অনেক দুর্নীতির মধ্যে থেকেও আমার এই পেটে (নিজের শরীরের দিকে ইংগিত করে) এক টাকার হারামও যায়নি। তোমরাও হালাল পথে থাকবা। তাতে একটু কষ্ট হলেও আল্লাহ বরকত দিবেন।

আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক সিলাই রেহীমি। আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে মিলে মিশে চলবে। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই নামাজ পড়বে, অনেকেই কম। কেউ কেউ হালাল উপার্জনের ব্যপারে অত্যধিক কড়া হবে আবার কেউ কেউ একটু দুর্বল থাকবে। শরীয়তে দুই রকম। আজিমাত এবং রুকসাত। আজিমাত হলো খুবই কড়া, কোন অবস্থাতেই সে হারামের কাছে যাবেনা। আর রুকসাত হলো পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য একটু ঢিল দেবে। তাই আত্মীয়দের মধ্যে কারও আয়ে সমস্যা থাকবে, কারও নামাজে দুবর্লতা থাকবে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো তাদেরকে সঠিক পথে আনার জন্য সবার সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখে মিলে মিশে চলা। আমি সব সময় এভাবে চলেছি এবং তাতে ভাল ফল পেয়েছি। হাদীসে আছে, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।

প্রতিবেশীর হক আদায় করবে। আমার ঢাকার বাসা, ফরিদপুরের বাড়ীর প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। আমার উত্তরার বাসার ব্যাপারে তো আমি আগেই লিখে দিয়েছি। মৌলিক কোন চেঞ্জ দরকার নেই। শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী মূল ভিত্তি ঠিক রেখে তোমরা সুবিধা মতো এদিক ওদিক চেঞ্জ করে নিও। ফরিদপুরের বাড়ী নিয়েও যেভাবে বলে দিয়েছি, সেভাবেই তোমরা কাজ করবে। আমরা ভাই ভাইদের মধ্যে কোন সম্পত্তি নিয়ে কখনো ঝামেলা হয়নাই। তোমরাও মিলেমিশে থাকবে। এসব নিয়ে কোন সমস্যা করবানা। শান্তির জন্য কাউকে যদি এক হাত ছাড়তেও হয়, তাও কোন ঝামেলা করবেনা, মেনে নিবে।

বেশী বেশী করে রাসুল (সা) এর জীবনী ও সাহাবীদের জীবনী পড়বে। আমি জানি তোমরা পড়েছো, কিন্তু তাও বার বার পড়বে। বিশেষ করে পয়গম্বর-এ-মোহাম্মাদী, মানবতার বন্ধু হযরত মোহাম্মাদ (সা:), সীরাতে সারওয়ারে আলম, সীরাতুন্নবী, সীরাতে ইবনে হিশাম, রাসুলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন। আর সাহাবীদের জীবনীর উপরও ভাল বই আছে। আগে পড়েছো জানি, তাও তোমরা পড়ে নিও।আমি আমার সন্তানদের উপর সন্তুষ্ট। তোমাদের ভুমিকার ব্যপারে সন্তুষ্ট।

আইনজীবীদেরকে আমার ধন্যবাদ ও দোয়া দেবে। তারা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাদের ভুমিকার ব্যপারে আমি সন্তুষ্ট। আইনজীবীরা যেভাবে পরিশ্রম করেছে, অবিশ্বাস্য। ওনারা যদি টাকা নিতো তাহলে ৫-১০ কোটি টাকার কম হতোনা। কিন্তু তারা অলমোস্ট বিনা পয়সায় তারা সাহসিকতার সাথে এই আইনী লড়াই চালিয়ে গেছেন।

আমার জানামতে শহীদের মৃত্যুতে কষ্টের হয়না। তোমরা দোয়া করবে যাতে আমার মৃত্যু আসানের সাথে হয়। আমাকে যেন আল্লাহর ফেরেশতারা পাহারা দিয়ে নিয়ে যান।