জীবনী : শহীদ আবদুল খালেক মন্ডল

মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য- ২০০১

জন্ম ও পারবারিক জীবন : জনাব মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল ১৯৪৪ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মোঃ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম মরহুমা দেলজান বিবি। তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যার জনক ।

শিক্ষা ও কর্মজীবন : তিনি দাখিল, আলেম ও ফাজিল পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষায় কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকে ২য় শ্রেণীতে ৬ষ্ঠ ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ-এতে ১ম শ্রেণীতে ২য় স্থান লাভ করেন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক

রাজনৈতিক জীবন : জনাব মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন ইউনিয়ন, থানা ও জেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ ও ১৯৯০ সালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলা জামায়াতের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শূরার সদস্য। তিনি ১৯৮৭ সাল হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার উন্নয়নের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পরে মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল বাংলাদেশ জামায়াতী ইসলামীর পক্ষ হতে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন একজন বলিষ্ঠ জননেতা হিসেবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁকে বাংলাদেশের একজন জনপ্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত করেন। তিনি ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় জনপ্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

শাহদাত : ২০১৫ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর ২০১৮ সালের ৫ মার্চ তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ তাকে ফাঁশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দন্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জেলখানাতেই ছিলেন। ২০ জুলাই বৃহষ্পতিবার সন্ধা ৬টার দিকে খুলনার আড়াইশ বেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

জানাজা : লাখো মানুষের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাবেক সদস্য, সাতক্ষীরা জেলার সাবেক আমীর ও সাতক্ষীরা-২ আসনের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, সমাজসেবক, প্রবীণ জননেতা অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেক মন্ডল এর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। জানাজায় অংশ নিতে শাকরা ফুটবল মাঠে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। শুক্রুবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে জানাযা নামাজ শেষে তাঁকে তাঁর পারিবারিক কবরস্থান সাতক্ষীরার সদর উপজেলার বৈকারি গ্রামে দাফন করা হয়।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকে মাওলানা আব্দুল খালেকের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স বৈকারি পৌঁছালে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন ছোট-বড় সবাই। এ সময় কাঁদতে থাকেন গ্রামবাসী।

জানাযা নামাজের আগে মরহুমের স্মৃতিচারণ করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ মোঃ ইজ্জত উল্লাহ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও খুলনা অঞ্চল পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যান ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মাষ্টার শফিকুল আলম, খুলনা মহানগরীর সাবেক আমীর আবুল কালাম আজাদ, সাতক্ষীরা জামায়াতের আমীর মুহাদ্দিস রবিউল বাশার, নায়েবে আমীর অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম মুকুল, শেখ নুরুল হুদা, জেলা সেক্রেটারী মাওলানা আজিজুর রহমান, এড, আব্দুস সুবহান মুকুল, শহর ছাত্রশিবিরের সভাপতি শিমুল হোসেন, সদর জামায়াতের আমীর মাওলানা শাহাদাৎ হোসেন, শ্যামনগর জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আব্দুর রহমান, কাজী সিদ্দিকুর রহমান, চেয়ারম্যান আব্দুল গফফর, শহীদ হাসানসহ অনেকে। বৈকারির শিকরা বিশাল ফুটবল ময়দানে অনুষ্ঠিত জানাযার নামাজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেয়।

মরহুমের জানাযা নামাজের আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল বর্তমান সরকারের জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মাজলুম অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর শাহাদাত কবুল করুন। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত আলেমে দ্বীন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সদালাপী মানুষ। আজকের এই মুহূর্তে বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর অশ্রুশিক্ত চোখ জায়নামাজ ভাসাচ্ছে এই প্রিয় মানুষটির জন্য। তিনি বলেন, জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে মাওলানা আব্দুল খালেক কেমন লোক ছিলেন।

সামাজিক জীবন : জনাব মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল ১৯৯৫ সালে উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রৌপ্যপদক লাভ করেন। তিনি স্থানীয় বেশ কিছু মসজিদ, গ্রোথ সেন্টার ও হেলথ কমপ্লেক্স নির্মান করেছেন। এছাড়াও তিনি আলামীন ট্রাস্টের সহ-সভাপতি ও জামিয়াতুল মুদাররেসিনের জেলা সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। তিনি ১৯৫৭ সালে আনসার এবং প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ (নিয়োরার) এর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত । তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন; যেমন: ভারত, নেপাল ও ভুটান ইত্যাদি।

কে এই আব্দুল খালেক মন্ডল? কেন তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের টার্গেটে পড়ে গেলেন?

২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৩। আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাইদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার দিন। এই দিন আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাইদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাতক্ষীরায় ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ রাজপথে বিক্ষোভ প্রতর্শন করে। রায় ঘোষণার পর দুপুর তিনটার দিকে সাতক্ষীরার কদমতলা মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের দিকে অগ্রসর হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজ মোড়ে পৌছালে যৌথবাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধ করে। এরপর বিক্ষোভ কারীরা প্রতিরোধ ভেঙ্গে শহরের দিকে প্রবেশ করতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেচের নির্দেশে পুলিশ বিজিবি গুলি চালায় । এতে জামায়াত শিবিরের ৬ নেতাকর্মী ঘটনাস্থলে শাহদাতবরণ করে।

এর পর থেকে টানা হরতাল অবরোধের ডাক দেয় জামায়াত। গোটা সাতক্ষীরা যেন উত্তাল হয়ে উঠে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে গোটা সাতক্ষীরা। বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ হারায়। একই সময় সাতক্ষীরা জামায়াতের আমীরের দায়িত্বে ছিলেন মাওলানা আব্দুল খালেক। আন্দোলন দমাতে তাকে টার্গেট করা হয়। প্রথমে বুলড্রোজার দিয়ে তার বসতবাড়ি ভাংচুর চালানো হয়। পরে তার নিকট আত্নীয় স্বজনদের বাড়িও বুলড্রোজার দিয়ে ভাংচুর করা হয়। গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল।

২০১৫ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৫ মার্চ তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ তাকে ফাঁশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দন্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জেলখানাতেই ছিলেন। ২০ জুলাই বৃহষ্পতিবার সন্ধা ৬টার দিকে খুলনার আড়াইশ বেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈকারি গ্রামে।

মাওলানা আবদুল খালেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রাথী হিসেবে বিপুল ভোটে সাতক্ষীরা সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর আগে তিনি সাতক্ষীরা সদরের বৈকারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সাতক্ষীরা আগরদাড়ী কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ আনা হয় মাওলানা আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে গোটা দেশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন অপরাধের তদন্তে স্বাধীনতাত্তোর গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট এবং সরকারি নথিতে কোথাও তাঁর নাম ছিল না। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পূর্ব পর্যন্ত তথাকথিত মিথ্যা অভিযোগে সারা বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা তো দূরে থাক একটি জিডি পর্যন্ত করা হয়নি।

মাওলানা আব্দুল খালেক বড় জামাই বর্তমান কুশখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুল গফফর। তিনি জানান, তার শ্বশুর মাওলানা আব্দুল খালেক অন্যান্ত ভাল মানুষ ছিলেন। সাতক্ষীরার সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি সাতক্ষীরা বাসীর সুখে-দুঃখে, সুদিনে-দুর্দিনে সব সময় সাথে ছিলেন। শ^শুরের ভাল বাসার কারণেই জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছেন।

আল্লাহ প্রদত্ত এক বিস্ময়কর প্রতিভা। ইসলামপ্রিয় জনগণের রুহানি উস্তাদ ও ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ। তিনি, ব্যক্তি জীবনে অল্পে তুষ্ট, স্বচ্ছ চিন্তা, সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্থ, অত্যন্ত ভদ্র-নম্র, মার্জিত, পরিশীলিত, মৃদুভাষী এক অসাধারণ ইসলামী ব্যক্তিত্বের অধীকারী ছিলেন। বার বারি নিবাঁচিত জনপ্রতিনিধি হয়েও তার বসতবাড়ির অবস্থা একেবারেই নাজুক।

স্থানীয়রা বলেন, অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেক সাতক্ষীরা অঞ্চলের একজন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ছাত্র জীবনের সকল পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন। কারাগারের বন্দী জীবনে তিনি কুরআন হিফজ করেন। পাকিস্থান আমলে আয়ুব সরকার তাকে স্বর্ণ পদক উপহার দেন। সাতক্ষীরার মানুষ তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।