জীবনী : শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী

শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ.

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আল্লামা সাঈদী রহ. বিশ্বখ্যাত একজন ইসলামিক স্কলার ও রাজনীতিবিদ। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ছিলেন। জালিমদের শত অত্যাচারে তিনি ছিলেন অবিচল। জীবনের শেষ ১৩ টি বছর তিনি বহুকষ্টে কারাগারে কাটিয়েছেন। তবুও জালিমদের কোনো ফাঁদে পা দেননি। জালিমের বশ্যতা স্বীকার করেননি। তিনি একাধারে আলেম, ইসলাম প্রচারক, লেখক, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও সংসদ সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের শীর্ষ জনপ্রিয় নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর জনপ্রিয়তা ধর্ম, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্র সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। হাসিনা সরকার তাঁকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

জন্ম ও শিক্ষা

শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানীর বালিপাড়া ইউনিয়নের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম ইউসুফ সাঈদী একজন আলেম, শিক্ষক ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন। শহীদ আল্লামা সাঈদী ছারছিনা আলিয়া মাদরাসা ও খুলনা আলিয়া মাদরাসায় তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তাফসির শাস্ত্রে কামিল পাশ করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি ইসলাম প্রচারের সাথে যুক্ত হন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি দীর্ঘ ৫ বছর ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, মনোবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাষার ওপর বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

পারিবারিক জীবন

আল্লামা সাঈদী রহ. ১৯৬০ সালে বেগম সালেহা সাঈদীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ৪ সন্তান। রাফীক বিন সাঈদী, শামীম বিন সাঈদী, মাসুদ বিন সাঈদী ও নাসিম বিন সাঈদী। এর মধ্যে ১ম সন্তান রাফীক বিন সাঈদী ২০১২ সালের ১৩ জুন ইন্তেকাল করেন।

সাংগঠনিক জীবন

সত্তরের দশক থেকে শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতের রুকন শপথ নেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য হন। আল্লামা সাঈদী ১৯৯৬ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হন। ১৯৯৮ সালে তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য হন। আল্লামা সাঈদী রহ. ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর হন। সেই থেকে শাহাদাত পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজনৈতিক জীবন

শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ. ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে ধারণ করার চেষ্টা করতেন। জামায়াতে ইসলামীর বেসিক শিক্ষাই এটা। ফলশ্রুতিতে তিনি এদেশের রাজনৈতিক কর্মকান্ডও যাতে ইসলামের বিধান অনুসারে হয় সেজন্য চেষ্টা সাধনা করেছেন। তিনি পিরোজপুর-১ আসন থেকে জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ার পরও তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।

সংসদে স্পিকারের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে ঢোকার যে শিরকি রীতি ছিল, আল্লামা সাঈদীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তা বন্ধ হয়েছিল। আল্লামা সাঈদী জামায়াতের পার্লামেন্টারি পার্টির ডেপুটি লিডার ছিলেন। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সদস্য ছিলেন। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পানি সম্পদ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কৃষি পুরস্কারের ট্রাস্টি বোর্ড মেম্বার ছিলেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যাকাত বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি বহু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৫ সনের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় স্টেডিয়ামে সাফ গেমস উপলক্ষে নির্মাণ করা হয়েছিলো চব্বিশ ঘন্টা প্রজ্জলিত থাকার জন্য ‘মশাল টাওয়ার’। মশাল টাওয়ার তথা আগুন পূজার বিরুদ্ধে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাওহিদী জনতাকে সাথে নিয়ে দেশে প্রবল গণ-আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন এবং মশাল টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলার জন্য সরকারকে এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। তদানীন্তন সরকার আল্লামা সাঈদীর সে আন্দোলনে ভীত হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই মশাল টাওয়ার ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল।

দ্বিতীয় দফা এমপি থাকাকালীন সময়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ৮ম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে ২০০৬ সালের ২৯ আগষ্ট তারিখে জাতীয় সংসদে ‘কওমী সনদের স্বীকৃতি’ এবং কওমী মাদরাসার সমন্বয়, উন্নয়ন ও পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য ‘কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ’ নামে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গঠনের বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেছিলেন।

জাতীয় সংসদে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী উত্থাপিত এই বিলের পরিপ্রেক্ষিতেই মূলতঃ পরবর্তীতে দাওরায়ে হাদীসকে ইসলামিক ষ্টাডিজ এবং এ্যারাবিক লিটারেচারে গ্রাজুয়েশান সমমান এবং এই ডিগ্রীধারীদের সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ কওে দেয়া সংক্রান্ত একটি নোটিফিকেশন জারি করেছিল তৎকালীন সরকার। যেটা পরবর্তীতে ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কেয়ারটেকার সরকারের সময়ে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর, বুধবার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রজ্ঞাপন নং: শিম/শা:১৬/বিবিধ-১১(৯)/২০০৩(অংশ)/১০৩১।

১৯৮৯-৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এক বজ্রকণ্ঠ ছিলেন আল্লামা সাঈদী রহ.। ১৯৯৪ সালে কেয়ারটেকার আন্দোলন, ১৯৯৮ সালের পার্বত্য কালো চুক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় লড়ে গিয়েছেন।

দাওয়াতী কাজ

১৯৬৭ সাল থেকে তিনি “দা’ঈ ইলাল্লাহ” হিসেবে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পৃথিবীর অর্ধশতেরও বেশি দেশে আমন্ত্রিত হয়ে ইসলামের সু-মহান আদর্শ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। মুসলিমদের তিনি কুরআনের অনুশাসন মানার জন্য আহবান করেছেন।

অমুসলিমদের তিনি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করেছেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি জালিমের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার আহ্বান করেছেন। তাঁর দাওয়াতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সহস্রাধিক অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন।

ক. চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দানে প্রতি বছর ৫ দিন করে দীর্ঘ ২৯ বছর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় । পবিত্র কাবা শরীফের সম্মানিত ইমাম এ মাহফিলে দু’বার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

খ. খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানসহ শহরের বিভিন্ন মাঠে প্রতি বছর ২ দিন করে দীর্ঘ ৩৮ বছর তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

গ. সিলেট সরকারী আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে প্রতি বছর ৩ দিন করে দীর্ঘ ৩৩ বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

ঘ. রাজশাহী সরকারী মাদ্রাসা মাঠে প্রতি বছর ৩ দিন করে দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

ঙ. বগুড়া শহরে প্রতি বছর ২দিন করে দীর্ঘ ২৫  বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

চ. ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে ময়দান ও পল্টন ময়দানে প্রতি বছর ৩ দিন করে দীর্ঘ ৩৪ বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

ছ. কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে তিনদিন  ব্যাপী প্রায় দীর্ঘ ৩১ বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি জেলায় তিনি তাফসিরুল কুরআন মাহফিল করার মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে দীর্ঘ অর্ধশত বছর কাজ করেন।

আল্লামা সাঈদীকে হত্যা চেষ্টা

অন্তত: চার বার হত্যা করার লক্ষ্যে কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদীর প্রতি সরাসরি গুলী ছুড়া হয়েছিল এবং আক্রমন করা হয়েছিল।

১.

প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৩ সালের ১৪ জানুয়ারী। উত্তরবঙ্গের চাঁপাই নবাবগঞ্জের একটি কলেজ মাঠে আয়োজিত তাফসীর মাহফিলে অংশগ্রহনের জন্য কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদী চাঁপাই নবাবগঞ্জ গমন করেন। মাহফিল শেষে তাকে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিলো সেখানে চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা গুলি ছুঁড়ে আক্রমন করে।

২.

হত্যা প্রচেষ্টার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৪ সালের ২৯ নভেম্বর। পাবনা শহরের অদূরে পুষ্পপাড়া আলিয়া মাদরাসা মাঠে আয়োজিত তাফসীর মাহফিলের প্রধান মেহমান ছিলেন আল্লামা সাঈদী। মাহফিল শেষে মাদারাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আইয়ুব আনসা শেষ হলে আল্লামা সাঈদীর বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ঐ মাদরাসারই প্রধান মুহাদ্দিস মাওলানা নুরুল্লাহ। খাবার শেষ হতে না হতেই হঠাৎ ঘাতকেরা গুলি চালায়। ঘাতকের ছুঁড়ে দেয়া একঝাঁক বুলেট মুহুর্তেই ঝাঝড়া কওে দেয় আল্লামা সাঈদীর পাশেই দন্ডায়মান মাওলানা নুরুল্লাহর শরীর। ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন মাওলানা নুরুল্লাহ। এভাবে সে যাত্রায়ও আল্লাহ তায়ালা একান্ত দয়া পরবশে আল্লামা সাঈদীকে ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

৩.

তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের ২১ অক্টোবর। হত্যাপ্রচেষ্টার ঘটনাটি ছিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। স্থানীয় বামপন্থী আর সমাজতন্ত্রীরা সন্ধার কিছু আগে স্থানীয় সাতকানিয়া স্কুল মাঠে আয়োজিত তাফসীর মাহফিলে অংশগ্রহনের পথে আল্লামা সাঈদীর গাড়ি আটকিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ আসার সাথে সাথেই সন্ত্রাসীরা যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। অস্ত্রসহ পুলিশ সেদিন ৫জনকে গ্রেফতারও করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে থানা পুলিশ সন্ত্রাসীদেরকে আর আটকে রাখতে পারেনি, ‘উপরের নির্দেশে’ তাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো পুলিশ। আল্লাহ তায়ালা সেদিনও আল্লামা সাঈদীকে বাতিল শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তাঁরই একান্ত দয়ায়।

৪.

হত্যা প্রচেষ্টার চতুর্থ ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিল রাজধানী ঢাকার পান্থপথে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজিত সীরাতুন্নবী (সা) মাহফিল। মাহফিলে প্রধান মেহমান ছিলেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। মাগরিবের নামাজের পর লক্ষ লক্ষ জনতাকে নিয়ে কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদী যেইমাত্র তার আলোচনা শুরু করেছেন, ঠিক তখনি ঘাতকেরা আল্লামা সাঈদীকে উদ্দেশ্য করে পরপর ৮/১০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। আল্লামা সাঈদী শাহাদাতের তামান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। মঞ্চে উপবিষ্ট শিবির সভাপতি আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহসহ সকলেই আল্লামা সাঈদীকে বসিয়ে দেওয়ার জন্য হাত ধরে টানতে থাকে, ব্যাকুল কন্ঠে অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু আল্লামা সাঈদী দৃঢ় কন্ঠে সেদিন বলেছিলেন, “মৃত্যুকে সাঈদী ভয় পায় না। আমি আমার জীবন মহান আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দিয়েছি। লাখো জনতার মধ্যে যদি আমি বসে যাই, তবে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?”

উপস্থিত লাখো জনতা জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাৎক্ষনিক আনোয়ারা হাসপাতাল ঘেরাও করে অস্ত্রসহ ৩জন গুপ্তঘাতককে ধওে ফেলেছিলো। বাকিরা পালিয়ে গিয়েছিলো। জনতা ঘাতকদেরকে পুলিশের হাতে সোপর্দও করেছিলো- কিন্তু তৎকালীন সরকার সন্ত্রাসীদের বিচার তো দূরের কথা, থানায় মামলাও গ্রহন করেনি।

সামাজিক কাজ

আল্লামা সাঈদী রহ. সামাজিক কাজ করে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাঁর এলাকার সকল মানুষকে আপন করে নিতে পেরেছেন। তাঁর দরজা থেকে কেউ খালি হাতে ফেরত যায়নি। তিনি সাধ্যমত সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়াও তিনি দেশী বিদেশী বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মাধ্যমে সেবা পেয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।

উপদেষ্টা – রাবেতা আলম আল ইসলামী, মক্কা আল মুকাররমা, সৌদি আরব

উপদেষ্টা – বাংলাদেশ সৌদি আরব মৈত্রী সমিতি

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য – শরীয়াহ কাউন্সিল, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ

চেয়ারম্যান – এক্সিকিউটিভ কমিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সদস্য – ট্রাষ্টি বোর্ড, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

সভাপতি – বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ

প্রতিষ্ঠাতা – দারুল কুরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা, খুলনা

চেয়ারম্যান – জামেয়া ই কাসেমিয়া, নরসিংদী

চেয়ারম্যান – তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টংগী

আজীবন সদস্য – ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

আজীবন সদস্য – বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি

চেয়ারম্যান – তা’লিমুল কুরআন ফাউন্ডেশন

চেয়ারম্যান – জামেয়া দ্বীনিয়া, টংগী, ঢাকা

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান – ইসলামিক কলেজ লন্ডন, ইংল্যান্ড

প্রতিষ্ঠাতা – নিউইয়র্ক ইসলামিক স্কুল, আমেরিকা

প্রতিষ্ঠাতা – আইটি এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, পিরোজপুর

প্রতিষ্ঠাতা – তাফহীমুল কুরআন দাখিল মাদরাসা, পিরোজপুর

প্রতিষ্ঠাতা – তাফহীমুল কুরআন কিন্ডার গার্টেন স্কুল, পিরোজপুর

প্রতিষ্ঠাতা – দারুল কুরআন মহিলা দাখিল মাদরাসা, পিরোজপুর

প্রতিষ্ঠাতা – এসডি মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদরাসা, পিরোজপুর

চেয়ারম্যান – দারুল হানান শিশু সদন, পিরোজপুর

উপদেষ্টা – বাংলাদেশ মসজিদ মিশন

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি – ইত্তেহাদুল উম্মাহ

পৃষ্টপোষক – আদর্শ স্কুল নারায়ণগঞ্জ

পৃষ্টপোষক – পিরোজপুর জনকল্যাণ ট্রাষ্ট

পৃষ্টপোষক – ইউকে ইসলামিক মিশন, ইংল্যান্ড

প্রধান পৃষ্টপোষক – হিফজুল কুরআন এন্ড ইসলামিক সেন্টার লন্ডন, ইংল্যান্ড

চেয়ারম্যান – তাফহীমুল কুরআন মাদরাসা, টাংগাইল

গ্রেপ্তার ও প্রহসনের রায়

কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে মাজার পুজারীদের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গ্রেপ্তার হন। ওই বছরের ২১ জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। ২ নভেম্বর তাঁকে কথিত ও সাজানো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা সাঈদীকে সাজানো মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

তাঁর মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে সারাদেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের এমন কোনো উপজেলা বাকী ছিল না যেখানে এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়নি। তাঁর ভালোবাসায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। যুবক, বৃদ্ধ, শিশু কিশোর এমনি নারীরা পর্যন্ত এই প্রহসনের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, অনেক এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় পর্যন্ত আল্লামা সাঈদীর এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রায় দুই সপ্তাহ দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। শেখ হাসিনা সরকার জনগণের বুকে গুলি চালিয়ে আল্লামা সাঈদীর প্রতি মানুষের ভালোবাসার জবাব দিয়েছিল। সারাদেশে আড়াই শতাধিক মানুষকে খুন করেছিল হাসিনা সরকার। পুলিশের নির্বিচার গুলিতেও মানুষ অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন মানুষের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এতো মানুষের জীবন দেওয়ার ঘটনা শুধু বাংলা নয় সারা পৃথিবীতে বিরল। এই অপার্থিব অর্জন কেবল আল্লামা সাঈদী রহ.-এর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে।

এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ পৃথক দুটি আপিল হয়। একটি করেন আল্লামা সাঈদীর পক্ষ, আরেকটি করে সরকারপক্ষ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ছয় অভিযোগে শাস্তির আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ এবং ফাঁসির আদেশ থেকে আল্লামা সাঈদীর খালাস চেয়ে আপিল করে আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা।

আপিল শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। বিচারপতিদের মধ্যে মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে আল্লামা সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন। তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।

শামসুদ্দিন মানিক তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি প্রতিবেশি রাষ্ট্রের পারপাস সার্ভ করেন বলে দেশবাসি মনে করে। অন্যদিকে বিচারপতি সিনহা বিভিন্ন সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন তারা সরকারের চাপে এই প্রহসনের রায় দিয়েছেন।

পেশাগত জীবন

পেশাগত জীবনে আল্লামা সাঈদী ছিলেন শিক্ষক ও লেখক। তাঁর লেখা বই রয়েছে ৭৭ টি।

শাহাদাত

২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট রবিবার সকালে বুকের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ.। তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কাশিমপুর কারাগার থেকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে পিজি হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারা কর্তৃপক্ষের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসতে সারাদিন ব্যয় হয়ে যায়। ১৩ তারিখ রাত ১১ টার পর তাঁকে পিজি হাসপাতালে আনা হয়।

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ-রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। প্রায় ৮৪ বছর বয়সী আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হার্টে পাঁচটি রিং পরানো ছিল। এতো সিরিয়াস একজন রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের পর থেকে শাহাদাত পর্যন্ত তাঁর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি।

১৩ আগস্ট রাত ১১ টায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর থেকে পরিবারকে তাঁর শারিরীক অবস্থা সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার পরিবারের সাথে কাউন্সিলিং করা ও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ১৪ আগস্ট রাত ৯ টায় পরিবারকে জানানো হয় তিনি ৮ টা ৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন।

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ-এর চিকিৎসা নিয়ে তাঁর পরিবার ও দেশবাসীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। আল্লামা সাঈদীর বিপুল জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে ১৪ আগস্ট ২০২৩ তারিখে তাঁর শাহাদাতের পর ঢাকায় জানাজা করতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার। তারা রাতের আঁধারে আল্লামা সাঈদীর লাশ পিরোজপুরে নিয়ে গিয়ে দাফন করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু সাঈদী ভক্তদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

আল্লামা সাঈদীর শাহাদাতের খবর শুনে মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষ পিজি হাসপাতাল ও শাহবাগ এলাকায় জমায়েত হয়। তারা সারারাত আল্লামা সাঈদী মৃতদেহ পাহারা দেয়। ১৫ আগস্ট সকালে ফজর নামাজ শেষে পুলিশ পিজি হাসপাতালে তান্ডব চালায়।

কোনো যুদ্ধকবলিত এলাকায়ও যা হয় নি, পিজি হাসপাতালে সেই কাজটাই করেছে সরকার। তারা হাসপাতালে টিয়ার শেল, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। হাজার হাজার রোগী শ্বাসকষ্টে পতিত হয়েছিল। ফজরের পর মুহুর্মুহু গুলি করে তারা আল্লামা সাঈদীর লাশ ছিনিয়ে পিরোজপুর নিয়ে যায়।

পিরোজপুরে আল্লামা সাঈদীর জন্মভূমিতে লাখ লাখ জনতা উপস্থিত ছিল। পুলিশ সেখানে গিয়েই দ্রুত কোনোমতে দাফন করে দিতে চায়। কিন্তু জনগণ আল্লামা সাঈদীর ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য করে পুলিশকে। অবশেষে পিরোজপুরে দুপুর ১ টায় ১ম জানাজা ও দুপুর ২ টায় ২য় জানাজা শেষে তাঁকে আল্লামা সাঈদীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে কাঁদিয়ে নশ্বর দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেছেন আল্লামা সাঈদী। আল্লামা সাঈদী শুধু একজন আলেম ছিলেন না তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিপ্লবী। তাঁর তাফসীরুল কুরআন মাহফিল শুধু মানুষের অন্তরে নয় গোটা জগতে সাড়া ফেলেছিল। তাঁর শাহাদাতে সারাবিশ্বের ইসলামপ্রিয় মানুষ শোক প্রকাশ করেছে। বিশ্বের সবক’টি ইসলামী আন্দোলন, বিশ্বখ্যাত আলেম ও দা’ঈগণ তাঁর শাহদাতে আবেগঘন বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছেন।

মহান রাব্বুল আলামীন এই মহান দা’ঈকে কবুল করুন, তাঁকে জান্নাতে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করুন। শুহাদা, সালেহিন, সিদ্দিকিন ও নবীগণের সাথে তাঁকে সম্মানিত করুন। আমিন।