জীবনী : শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একটি জীবন, একটি ইতিহাস। আল্লাহ প্রদত্ত এক বিস্ময়কর প্রতিভা। ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছ চিন্তা, সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, নরমদিল ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী, অত্যন্ত ভদ্র-নম্র, মার্জিত, পরিশীলিত, মৃদুভাষী এক অসাধারণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শান্তি ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রিয় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর এবং বাংলাদেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ, সুলেখক, ইসলামপ্রিয় জনগণের রুহানি উস্তাদ ও বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ। ২০১৫ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সংস্থা “দ্য রয়েল ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার” প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে ২৮ অক্টোবরের কথা। ২০০৬ সালে পল্টনের সেই ভয়াল দিনে মাওলানা নিজামী যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন পল্টনে চলছিল যুদ্ধাবস্থা। তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে শান্তভাবে তার বক্তব্য চালিয়ে গিয়েছেন। বার বার বলছিলেন শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। নেতা কর্মীদের বার বার নির্দেশ দিচ্ছেন সবাই যাতে শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। সেদিন জামায়াত-শিবিরের শত শত নেতাকর্মীরা হতাহত হলেও মাওলানা নিজামীর ধৈর্য্য ধরার কঠোর নির্দেশ তারা পালন করে। একজন নেতার কঠোর দূর্যোগ মুহুর্তেও ঠায় দাঁড়িয়ে ধৈর্য্যের উপদেশ দিতে পারার হিম্মত মাওলানা নিজামীকে না দেখলে বোধহয় আমাদের দেখার সুযোগ হতো না। মাওলানা নিজামী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে তার ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন । ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরপর তিন বছর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রআন্দোলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দুইবার তিনি গোটা পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

মওলানা নিজামী ছাত্রজীবন শেষ করে বৃহৎ ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। ১৯৭৮-১৯৮২ পর্যন্ত তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩-১৯৮৮ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি । ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং আমীর নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত (২০০০সাল) দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী ৯০ এর আন্দোলন, ৯৬ তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রর্বতনের আন্দোলন সহ তিনি অন্যান্য সকল রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপামর জনতার সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর তিনি। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন ২০০১-২০০৩ এবং ২০০৪-২০০৬ সেশনে। তিনি ২০০৭-২০০৯ এবং ২০১০-২০১২ সেশনে পুনরায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বচিত হন ।

সুস্থ রাজনীতির চর্চাঃ
বাংলাদেশের কলুষিত রাজনৈতিক চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন শুরু থেকেই। ১৯৯১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে তার দেয়া বক্তব্য তিনি রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের কেমন আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই বিষয়ে এই বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথমে সরকারি দলকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন শিক্ষণীয় ভূমিকা নিতে হবে তাদেরকেই। জাতি এটাই কামনা করে। পরমত সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। বিরোধী দলের সমালোচনা সহ্য করার অনুরোধ করেন। সেই সাথে তিনি বিরোধী দলের ব্যাপারে বলেন, “জাতি বিরোধীদলের ভূমিকাকেও গঠনমূলক দেখতে চায়। আবেগ নির্ভর হয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে গিয়ে যাতে পরিবেশ ক্ষুন্ন না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা দরকার। অপজিশনের খাতিরে অপজিশন, বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা যাতে না করে”। তিনি আরো বলেন, “অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যে জাতি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না সত্যিকার অর্থে সে জাতি তার ভবিষ্যতকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারেনা। কিন্তু ইতিহাসের আলোচনা শিক্ষাগ্রহনের উদ্দেশ্যেই হওয়া উচিত। কোন তিক্ততা সৃষ্টির জন্য অতীতের ইতিহাসের আলোচনা হলে যদি পরিবেশ বিঘ্নিত হয় সে ধরণের আলোচনা যেন আমরা সকলেই পরিহার করি”।

ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টাঃ
মাওলানা নিজামী সবসময় ইসলামপ্রিয় দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, “জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এদেশের সকল ইসলামী দলকে আপন মনে করে, অন্তর থেকে তাদেরকে শ্রদ্ধা করে। আমি এতটুকু বলতে চাই, ভুল বুঝাবুঝির কারণে হোক বা যে কারণেই হোক জামায়াত ইসলামীর বিরুদ্ধে যারা সমালোচনা করেন তাদের বিরুদ্ধেও আমরা কোন কথা বলি না বলবো না। সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মত পরিস্থিতিতে জামায়াত ইসলামী আজ পর্যন্ত শরিক হয়নি। ভবিষ্যতেও হবেনা। আজকের এই সময়টি ইখতিলাফ নিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার সময় নয়। ইসলামে মতপার্থক্য ছিল, আছে এবং থাকবে। যে যেমতে বিশ্বাসী তাকে সে মতে থাকতে দিন। জোর করে একজনের মতের উপর আরেকজনের মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেই সেখানে ফিতনা ফাসাদের জন্ম হতে পারে। জামায়াতে প্রথম থেকেই এই ব্যাপারে সজাগ আছে, সজাগ থাকবে”।

“আমরা বিশ্বাস করি, যারা কুরআন হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত তারা যদি আমাদের বিরুদ্ধে ফতোয়াও দেন তবুও তারা যে কাজটি করছে সে কাজটি আমাদের কাজ। তারা হয়তো কোন ভুল তথ্য পেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ কথা বলছে কিন্তু তারা যেহেতু আমাদেরই কাজ করছে তাই তাদের বুকে টেনে নেয়ার মত উদার আমাদের হতে হবে”।

মাওলানা নিজামীর স্বভাবসুলভ বিনয়ঃ
তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনোই কাউকে ধমক দেয়া, বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি অসম্মান কিংবা কোন প্রকার কটুক্তি করেননি। অথচ বিরোধী দলের প্রতি কটুক্তি করা বাংলাদেশের খুবই প্রচলিত আচরণ। স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে তিনি সমালোচনার জবাব দিতেন। সংসদে কারো বক্তব্যের বিরোধীতা করার প্রয়োজন হলে অথবা প্রতিবাদ জানানোর দরকার হলে তিনি তা করতেন অত্যন্ত সম্মানের সাথে। ওলামা মাশায়েখদের এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয়ার সময় তার বিনয় আমাদের কাছে আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি ইসলামিক দলের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও বলেন “এখানে যারা আসছেন তারা সবাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা মসজিদের ইমাম এবং খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন। আমি নিজে শিক্ষক নই, কোন মসজিদের ইমাম নই খতীব নই। আমি ছাত্র এবং মুক্তাদী। সুতরাং সমস্ত ওলামায়ে কেরামকে আমি আমার ওস্তাদতুল্য মনে করি সম্মান করি। আমি আপনাদের ইমাম ও খতীব হিসেবে শ্রদ্ধা করি”। এভাবে সব দল মত পেশার মানুষকে তিনি সম্মান করতেন। কথা বলতেন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে।

বাবরী মসজিদ প্রসঙ্গে মাওলানাঃ
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর উপমহাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন বাবরী মসজিদ ভেংগে দেয়া হয়। ভারতে বাবরী মসজিদ ভাংগার প্রতিবাদে সারা দুনিয়াব্যাপী মুসলমানরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মসজিদ ভাংগার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে এদেশের বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ৫ম জাতীয় সংসদে বাবরী মসজিদের উপর আলোচনার জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রথমে সরকারী দল ও বিরোধী দল আলোচনার প্রস্তাবে রাজী হয়নি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের চাপে অবশেষে সংসদে বাবরী মসজিদ প্রসংগ আলাচনার জন্য উপস্থাপিত হয়। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশের তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে বাবরী মসজিদ প্রসংগে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। মাওলানা নিজামী মসজিদ ভাংগার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করে বলেন, বাবরি মসজিদ নিছক একটি মসজিদ নয়, ইসলামী আদর্শের, ইতিহাস, ঐতিহ্যের এবং সভ্যতার একটি বিরল প্রতীক এটি। তাই বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া সাধারণ কোন ব্যাপার নয়। এটাকে বিবেচনা করতে হবে আদর্শের উপর আঘাত, ইতিহাসের উপর আঘাত, একটি সভ্যতার উপর আঘাত, একটি ঐতিহ্যের উপরে আঘাত হিসাবে। গোটা বিশ্ব আজ এই কার্যক্রমের নিন্দা করছে। বাংলাদেশের দলমত নির্বিশেষে ১২ কোটি মানুষ এর নিন্দা করছে। সেই ১২ কোটি মানুষের এই সংসদ এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি নিন্দা প্রস্তাব নেবে এটাই জাতির প্রত্যাশা। মাওলানা নিজামী ভারতীয় মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধান ও মুসলিম জাতিসত্ত্বা বিনাশের চক্রান্ত রুখে দাড়ানোর আহবান জানিয়ে জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে বলেন, “বাবরী মসজিদের ঘটনা নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সাথে আরো অনেক কিছু জড়িত আছে। আমি মনে করি, শুরু থেকে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের অনুসারী বর্ণ হিন্দুবাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য দৃষ্ট হচ্ছে এ বাবরী মসজিদ ভাংগা তারই একটা প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। বাবরী মসজিদ ভাংগার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হচ্ছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বানচাল করা এবং সার্ককে অকার্যকর করা। কারণ সার্ক এর অস্তিত্ব ভারতের আধিপত্যবাদী, আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী চরিত্র তথা মানসিকতার পথে একটা বড় বাধা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলো একত্রিত হয়ে ভারতের পাশাপাশি এক টেবিলে বসার সুযোগ আধিপত্যবাদী মানসিকতা চিরতার্থ করার পথে একটি বড় অন্তবায়। তাই ভারত সার্ককে মন থেকে চায় না”। মাওলানা নিজামী জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে ভারতের মুসলিম জাতিসত্ত্বা ধ্বংসের সর্বনাশা পরিকল্পনা, আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল ও আওয়ামী লীগের ভারতপ্রীতির সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন।

ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে সংসদে আলোচনা:
ফারাক্কা বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের জন্য জীবন মরণ সমস্যা। ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করে আসছে। জাতীয় সংসদে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর ২০ জন এম পি একযোগে দাড়িয়ে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন্য স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্পীকার জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের দাবীর প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করেন। মাওলানা নিজামী ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাতীয় সংসদে তুলে ধরে এ সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার দাবী জানান। তিনি জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে বলেন, মাননীয় স্পীকার, ফারাক্কার কারণে যে সেচ অসুবিধা হয় তাতে প্রায় ৩ লক্ষ একর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আদ্রতা হ্রাসের কারণে ৩০লক্ষ একর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, লবনাক্ততার কারণে ৬৪ লক্ষ একর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার আমাদের আছে। আমেরিকা মেক্সিকোর তুলনায় অনেক বড় দেশ, একটি মহাদেশ। কিন্তু কলোরাডা নদীর পানির উপর আমেরিকার যে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। সুতরাং এ ব্যাপারে ঐক্যমতে আসা দরকার। সেই সাথে বিকল্প বাধের ব্যাপারে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

বসনিয়া পরিস্থিতিতে উদ্বেগ:
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জাতীয় সংসেদ বসনিয়া-হারজেগোভিনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতীয় সংসদের স্পীকারের প্রতি নোটিশ প্রদান করেন। পার্লামেন্টের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর এই প্রথম সার্ববাহিনীর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। মোট এক ঘন্টার আলোচনার মধ্যে মাওলানা নিজামী জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে একাই আধঘন্টা আলোচনা করেন। তার এ আলোচনা জাতীয় সংসদে উপস্থিত সকল সদস্যের আবেগ ও অনুভূতিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মজলুম মাবনতার পক্ষে নিজামীর আবেগময় বক্তব্য জাতীয় সংসদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষারে লেখা থাকবে।

পুশব্যাক:
ভারত সরকার মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে পুশব্যাকের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জননেতা নিজামী জাতীয় সংসদে ভারত সরকারের এ ঘৃণ্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে ভারতের পুশব্যাককে পুশইন বলে আখ্যায়িত করেন। মাওলানা নিজামীর এ পুশইন জাতীয় সংসদে সকলের সমর্থন লাভ করে। ফলে ভারতীয় চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

ফাজিল ও কামিল-এর ডিগ্রী ও মাস্টার্স এর সমমান প্রদান ভূমিকা:
বহুদিন ধরেই এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যাবস্থা ছিল অবহেলিত। সরকারিভাবে এখান থেকে নেয়া ডিগ্রীর মান দেয়া হতো না। এর প্রভাবে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কারণ মাদ্রাসা ছাত্রদের সার্টিফিকেটের মূল্য না থাকায় সরকারি চাকুরিসহ নানা চাকুরিতে বৈষম্যের শিকার হতে হতো। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মাওলানা নিজামী ফাজিল-কামিলকে ডিগ্রী ও মাস্টার্স-এর সমমান প্রদান আন্দোলনে ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় মন্ত্রীসভার এ সংক্রান্ত কমিটিতে তিনি অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৬ সালে এ কমিটিতে ফাজিল ও কামিলকে যথাক্রমে ডিগ্রী ও মাস্টার্সের সমমান প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মন্ত্রীসভায় তা পাস হয় এবং জাতীয় সংসদে তা অনুমোদিত হয়।

টিপাইমুখ নিয়ে মাওলানার ভূমিকা:
সিলেটের জকিগঞ্জ হতে ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের মনিপুর রাজ্যে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ করছে ভারত। সুরমা-কুশিয়ারা ও মেঘনা নদীর পানি আসে এই পথে। এটি ৯৩০ মি দীর্ঘ ও ৯৬৯ মি উচু একটি বাঁধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি হবে আরেক ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধ হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নারায়ণগঞ্জ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গ্রীস্মকালে ৯৪৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মরুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে, বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে, প্রায় ৫ কোটি মানুষ ক্ষতিকর প্রভাবের স্বীকার হবে, ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং শতাধিক নদী মরে যাবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। সিলেটে টিপাইমুখ অভিমুখে নৌমার্চ, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় মহাসমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। পল্টনে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে আয়োজিত সমাবেশে মাওলানা নিজামী বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে নয়। কোন বিশেষ দেশের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জামায়াতে ইসলামী অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হলে সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং বাংলাদেশের কোন স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে রুখে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। সাউথ এশিয়ান টাস্কফোর্স, টিকফা, ট্রানজিট বিরোধীতায় তিনি ছিলেন সরব। “টিপাইমুখ বাঁধের কারণে পারমানবিক বিস্ফোরণের মতই ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ। টিপাইমুখে বাঁধ দিলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা নদী মরে যাবে। ফারাক্কার ক্ষতি সমূহের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের অহংকার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এক ফারাক্কার কারণে পদ্মা- যমুনা মরে গেছে। এখন মেঘনা যদি মরে যায় বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে ভাতে ও পানিতে মারার ষড়যন্ত্র হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ”। তিনি সরকারকে আহবান করেন টিপাইমুখ নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠন করতে। অযথা সরকারের সমালোচনা না করে তিনি বলেছেন সরকার যদি টিপাইমুখের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে আমরা সরকারের হাতকে শক্তিশালী করবো। মাওলানা নিজামীর নেতৃত্বে সকল বিভাগীয় শহরে জামায়াত টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে জনসমাবেশের আয়োজন করে এবং জনগণকে সচেতন করে। জামায়াতে ইসলামীর দেশব্যাপী প্রচারণায় এটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ছাড়া সর্বমহল থেকে এ বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উঠে। অথচ সরকার এদিকে তো কর্ণপাত করেনি বরং সরকারের তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, আগে বাঁধ হোক, পরে দেখা যাবে।

ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কন্ঠঃ
জঙ্গীবাদের নামে ইসলামকে কলুষিত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র নিয়ে তিনি সারাজীবন কথা বলেছেন। এটাকে বিদেশী ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে তিনি বলেছেন বিদেশী শক্তি অনুপ্রবেশের জন্য এবং বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর জন্যই এতসব আয়োজন। জেএমবি নির্মূলে জোট সরকারের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন “পৃথিবীতে একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশই জঙ্গী নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। আর এই সক্ষম হওয়ার পিছনে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রেখেছেন এদেশের আলেম সমাজ। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন ওলামায়ে কেরাম। তারা প্রতিটি মসজিদ থেকে এই আওয়াজ তুলেছেন এই জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এতে যারা বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছিলেন তারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের জঘন্য ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়”।

মাওলানা নিজামী ইসলাম বিরোধী শক্তিদের ষড়যন্ত্র নিয়ে সবসময় সতর্ক করে গেছেন। ইসলাম বিরোধীরা ইসলামের মধ্যে বিভক্তির চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক ইসলাম এবং আধ্যাত্মিক ইসলাম বলে মুসলমানদের আলাদা করার প্রয়াস চালিয়েছে। আধ্যাত্মিক ইসলামকে প্রমোট করার মাধ্যমে যারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছে। পীর-মুরিদ তাসাউফ চর্চাই মূলত ইসলাম অন্য কিছু ইসলাম বহির্ভুত। ইসলামে রাজনীতি বলে কিছু নেই। এই ধরণের অপপ্রচার থেকে বেঁচে থাকার পরামর্শ তিনি সবসময় দিয়েছেন।

কৃষি মন্ত্রনালয়ে অবদান:
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা পচাশি জন লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই মাওলানা নিজামী কৃষি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিয়েই কৃষকদের জন্য কাজ করার ব্যাপারে মনযোগী হন। ফসলের ন্যায্য পাওনা, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ যাবতীয় কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাদের যাবতীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং এর সুষ্ঠু সমাধানকল্পে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এলক্ষ্যে তিনি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সফরের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, বিজ্ঞানী ও কৃষকদের মাঝে প্রানচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন। মাওলানা নিজামী কৃষি মন্ত্রনালয় দায়িত্ব পালনকালে “চাষীর বাড়ী, বাগান বাড়ী” শ্লোগানকে দেশব্যাপী জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিনত করেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের প্রতিটি চাষীর বাড়িকে এক একটি বাগান বাড়ি হিসাবে গড়ে তুলে নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরন বাড়তি উপার্জন এবং স্বাবলম্বিতা অর্জন সহজ হয়েছে। মাওলানা নিজামীর ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় বৃক্ষ রোপন অভিযানে পৃথকভাবে ফলজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে আলাদাভাবে ফলজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। সরকারের একজন মন্ত্রী হিসাবে তিনি নিজে বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষরোপন করেন এবং অন্যানের মধ্যে বৃক্ষের চারা বিতরণ করে বৃক্ষরোপনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির প্রয়াস চালিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন ফল চাষ প্রকল্প ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, জনগণকে উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই ধানের ফলন বৃদ্ধি এবং সঠিক সংরক্ষনের দিকে ছিল তার সতর্ক দৃষ্টি। ধানের প্রধান দুই শক্র ইদুর এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রনে তার মন্ত্রনালয়ের পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসা করার মত । আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সম্মেলনে তার ছিল সরব ভূমিকা। বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে মাওলানা নিজামীর সুপরিকল্পিত নির্দেশনার ছাপ। আখ, পাট, তুলা, ভূট্টা, মধু এমনকি শীতকালীন শাকসবজি পর্যন্ত তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি এবং কৃষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় কৃষি মেলার। এ ক্ষেত্রেও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মাওলানা নিজামীর আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। তার দিক নির্দেশনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম রাজশাহী, নওগা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশের কৃষি উন্নয়নে মাওলানা নিজামীর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো বি এ ডি সি বীজ উইং শক্তিশালী করণ, মাটিরগুনগত মান পরীক্ষাকরণ, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম পর্যালোচনা, কৃষিবিদ কৃষিবিজ্ঞানীদের যথাযথ পদোন্নতি এবং ব্লক সুপারভাইজার পদবী পরিবর্তন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদ চালু।

শিল্প মন্ত্রনালয়ে অবদান:
বিগত ২০০৩ সালে ২৫শে মে কৃষি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থেকে মাওলানা নিজামীকে শিল্প মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। উদ্দেশ্য ভেঙে পড়া বিপর্যস্ত রাষ্ট্রীয় শিল্পখাতকে পুনরুজ্জীবিত গতিশীল ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনা। দায়িত্ব নিয়েই মাওলানা নিজামী দেশের শিল্পক্ষেত্রে নতুন গতিসঞ্চারের প্রয়াস পান। বাংলাদেশের শিল্পখাতের সমস্যাগুলো তিনি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ সমস্যা দূরীকরণকল্পে তিনি দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দ্রুত বিকাশের লক্ষে পৃথক শিল্পনীতি প্রনয়ন করেন । এ নীতি প্রনয়নকালে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তা ও সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে মত বিনিময় করা হয়। নতুন শিল্পনীতি ২০০৫ সালে ৩২টি শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হিসাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্বিক দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য মাননীয় শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি দিকনির্দেশনা কমিটিও গঠন করা হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এ কমিটি বৈঠকে মিলিত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিরাজমান সমস্যা সমাধানকল্পে বাস্তবসম্মত কর্মপন্থা ও সুপারিশমালা প্রনয়নের কাজ করে চলেছে। ২০০১-০২ অর্থ বছরে যেখানে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ছিল ১৫.৭৬% ভাগ, সেখানে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৬.৫৮% ভগে। একই বছরে শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪৪% ভাগ যা ২০০৫ সালে এসে দাড়িয়েছিল ৭.৪৮% ভাগে। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার যোগ্য নেতৃত্বে দেশের শিল্পভিত্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে । চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মাওলানা নিজামীর দায়িত্বাধীন শিল্পমন্ত্রনালয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যা দেশের শিল্পাঙ্গনে নতুন প্রান স্পন্দন সৃষ্টি করেছিল। দেশে মিশ্রসারের চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রামে দৈনিক ৮০০মে: টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট ডিপিএ-১ ও ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট ডিপিএ-২ নামে দুইটি নতুন সার কারখানা স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন কর্পোরেশনের আওতায় সম্ভাবনাময় বন্ধ শিল্পসমূহ পূনরায় চালু করার ব্যাপারে মাওলানা নিজামীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত ইতিবাচক। তারই ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রানান্তকর প্রয়াসে কর্ণফুলী পেপার মিলের বন্ধকৃত কস্টিক ক্লোরিন প্লান্ট, খুলনা হার্ডবোর্ড মিল এবং রংপুর সুগার মিল পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে। ফলে তখন এ ২টি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানই লাভজনক অবস্থায় পরিচালিত হয়। এই লাভ ধরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন দীর্ঘ ১০ বছরের মধ্যে ২০০৫-০৬ আখ মাড়াই মৌসুমে মাওলানা নিজামী মন্ত্রী থাকাকালে প্রথম বারের মতো ৭০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ উন্নয়নের জন্য হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারি শিল্পকে সাভারে নতুন স্থাপিত চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন চলছে। এছাড়া ফার্মাসিউটিকেল ইন্ডাস্ট্রি, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ও অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের জন্য পৃথক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে হয়েছে। লবন আমাদের দৈনন্দিন ভোগ্যপন্যের একটি অপরিহার্য উপদান। দেশে মোট সাড়ে ১১ লাখ মে. টন লবনের চাহিদা থাকলেও বিগত ২০০৫-০৬ উৎপাদন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার মে. টন লবন উৎপাদিত হয়েছে যা এ যাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। নি:সন্দেহে এ অর্জন মাওলানা নিজামীর সঠিক দিক নির্দেশনার ফসল। এ ছাড়াও বিগত ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে শিল্প মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ স্টিল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন তাদের উৎপাদন লক্ষমাত্রা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। মাওলানা নিজামীর দায়িত্বাধীন শিল্পনালয়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো বিসিকের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৭৫ জন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, বি এস টি আই এর আধুনিকায়ন, ফুড ফর্টিফিকেশন এলায়েন্স গঠন, ন্যাশনাল এক্রিডিটেশন এবো গঠন ইত্যাদি জাতীয় মেধা সম্পদের অধিকার সংরক্ষন শিল্পের ব্যাপারে আমীরে জামায়াতের বক্তব্য ছিলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট এভাবে মন্ত্রী হিসাবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রতিটি ক্ষেত্রেই সততা দক্ষতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন কালে তার দরদী মন ও সুন্দর আচরণ আজো স্মরণ করেন কর্মকর্তা কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সকলে।

মাওলানা নিজামীর নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন:
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানামুখী ব্যস্ততার পরও মাওলানা নিজামী তার নিজ এলাকা সাথিয়া বেড়া থেকে এতটুকু বিমুখ হননি। সাথিয়া বেড়াবাসীর নন্দিত নেতা তিনি। এ এলাকার জনগণ তাকে তাদের এযাবতকালের শ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে গ্রহন করেছে। উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া সাথিয়া বেড়া তথা পাবনাবাসীর নিকট তিনি কর্মনিষ্ঠা, সততা আর দক্ষতার মূর্ত প্রতিক। এমন কি প্রাকৃতিক দূর্যোগকে উপেক্ষা করেও তিনি তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। মাওলানা নিজামী বিশ্বাস করেন যে যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা রাস্তাঘাট ও ব্রীজ কালভার্টের উন্নয়ন যে কোন এলাকার উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাই তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই সাথিয়া বেড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে নজর দেন। জোট সরকারের আমলে তিনি ১৮৫ কি মি সড়ক পাকা করেছেন। পৌরসভার প্রায় প্রতিটি রাস্তাই সংস্কার ও উন্নয়নের ছোয়া পেয়েছে। আজ সাথিয়া বেড়া কোন অনুন্নত এলাকার নাম নয় একটি সম্ভবনার নাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ হলো শালগড় ঈদগাহ মাঠ হতে কালাইচড়া আব্দুল হামিদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা, ভবানিপুর থেকে শালগড় ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত সড়ক, বেড়া ডাকবাংলো থেকে সাথিয়া হয়ে মাধবপুর বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়ক, দেবিপুর তেবাডয়া বাজার থেকে স্বরগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়ক, মাধবপুর বিশ্বরোড় হতে দবিরশেখের বাড়ি হয়ে আবু বকর সিদ্দিকের বাড়ি সড়ক, নওয়ানী ফয়জের বাড়ী হতে ফজলুল হকের বাড়ি, হতে ঈদগাহ মাঠ সড়ক হতে নাটিয়া বাড়ী বিশ্বরোড পর্যন্ত রাস্তা মেরামত, আফড়া তমিন সরকারের বাড়ির ব্রীজ, হাজরাতলা বটগাছ মোড় হতে ভুলবাড়িয়া ইউপি অফিস সড়ক, নাড়িয়া গদাই থেকে জোড়গাছা সড়কে ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ নির্মান, হলুদঘর থেকে গোপালপুর সড়কে ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ নির্মান, সোনাতলা ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ, ভুলবাড়িয়া হতে হাট বাড়িয়া সড়কে ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আরো অনেক সড়ক তার প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সংস্কার বা মেরামত করা হয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি অবকাঠামোগত আরও অনেক উন্নয়ন মাওলানা নিজামীর হাত ধরেই হয়েছে। জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা বিস্তারে মাওলানা নিজামীর রয়েছে অনন্য অবদান। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সাথিয়া বেড়া অঞ্চলের ১০টি মাদ্রাসার এমপিওভূক্তি বাতিল করা হয়। জোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরপরই তা পূর্ণবহাল করা হয়। তার প্রত্যক্ষ আনুকূল্যে এখানকার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের সোপান খুজে পেয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : সাথিয়া ডিগ্রী কলেজ, আল হেরা একাডেমী, ইমাম হোসেন একাডেমী, নাকালিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাকালিয়া বাতেনিয়া দাখিল মাদ্রাসা, বেড়া আলিম মাদ্রাসা, হুইখালি বাংলা উচ্চবিদ্যালয়, সাথিয়া যশোমন্ত দুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিষ্মুবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, খলিশাখালি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পীরহাটিসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলোকদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরপাইরহাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলন্দা উচ্চ বিদ্যালয়, পাথাইলহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাগডেমরা ১নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাথিয়া ডিগ্রী কলেজ, বোয়াইলমারী কামিল মাদ্রাসা, সাথিয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মনজুর কাদের মহিলা কলেজ, বেড়া আল হেরা একাডেমী, বেড়া ডিগ্রী কলেজ, বেড়া আলিম মাদ্রাসা, বেড়া বি বি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি। আমাদের দেশের জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদে পরিনত করতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই এ কথাটি তিনি যথাথই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা উন্নয়নই নয়, ছাত্র ছাত্রীদেরকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতেও মনোনিবেশ করেন। এর মধ্যে কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধনা, পুরস্কার প্রদান, বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মাওলানা নিজামীর প্রত্যক্ষ উদ্যোগ ও অর্থানুকূল্যে সাথিয়া বেড়া উপজেলায় বাস্তবায়িত আরো কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে, মসজিদ মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মান, উন্নয়ন ও অর্থায়ন, বিদ্যুতায়ন, বৃক্ষরোপন, স্বস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মান ও উন্নয়ন। আমরা জানি, বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি দুষ্ট ক্ষতের ন্যায় কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগও রয়ে গেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাসই প্রধান। সাথিয়া বেড়া বা পাবনাও এ থেকে মুক্ত নয়। বেড়াকে যমুনা নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষার জন্য তার আন্তরিক প্রয়াস সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। বেড়া পানি উন্নয়ন বোডের অধীনে যমুনার পশ্চিম তীর সংরক্ষন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সে কাজে ব্যয় নিরুপন করা হয়েছে ২৫০,০০,০০০/= টাকা। ফলে কৃষকরা আগে যেখানে বছরে একটি মাত্র মৌসুমে ফসল পেত সেখানে এখন তিনটি ফসল ফলানো সম্ভব হবে। বিগত বন্যায় অসহায় মানুষ তাকে যেভাবে কাছে পেয়েছে তাতে তিনি তাদের চোখের মনিতে পরিনত হয়েছেন। জীবনের ঝুকি অগ্রাহ্য করে তিনি নিজে ঘুরে ঘুরে দেখছেন বন্যার্তদের অবস্থা। তাদের মাঝে বিতরণ করেছেন চাল ডালসহ খাদ্রদ্রব্য, পরিধেয় বস্ত্রাদি এমন কি জীবন রক্ষাকারী ঔষধও। বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন জনগণের মনে সাহস সঞ্চার করার। শুধু এখানেই নয়, দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্থরা যাতে আবার দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে তার জন্য নগদ অর্থ, ঢেউটিন বিতরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন।

কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার : রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার জামায়াত নেতৃত্বকে সাজা দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে। ১৯৭৩ সালের আইনে সংশোধন এনে দলীয় তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগ ও সাজানো সাক্ষী দিয়ে কথিত মানবতাবিরোধী বিচারের রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই বিচারের জন্য প্রণীত আইন ও বিধিমালা নিয়ে শুরু থেকেই দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞগণ গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ, আইনজীবীদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট্স ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা এ নিয়ে আইন সংশোধনের জন্য নানা সুপারিশও দিয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাতই করেনি। সরকার তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দকে একের পর এক হত্যা করেই চলছে। ইতোমধ্যে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই বিচার হচ্ছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার জন্যই আইন :
যুদ্ধাপরাধের জন্য প্রণীত আইনটি নিজেই ন্যায়বিচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এটি মূলত এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে রাষ্ট্রপক্ষ সবক্ষেত্রেই আইনি পন্থায় বেআইনি সুবিধা লাভ করতে পারে। ট্রাইব্যুনাল গঠন থেকে শুরু করে তদন্ত, বিচারক নিয়োগসহ সাক্ষ্যগ্রহণ এমনকি ফাঁসি কার্যকর করা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই এ বিশেষ সুবিধার প্রতিফলন ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৬ নং ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। যেখানে সরকার নিজেই বাদি সেখানে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারক নিয়োগের এখতিয়ার সরকারের হাতে থাকায় নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল গঠন বা ন্যায়বিচার কোনটি-ই সম্ভব না। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল চাইলে দ্রুত বিচারের স্বার্থে কোনো সাক্ষ্য ছাড়াই বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পারবে আবার চাইলে রায় দেয়ার জন্য একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যই পর্যাপ্ত মনে করতে পারবে।

শুধু তাই নয়, দেশীয় আদালতে বিচার হলেও সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির মত মৌলিক আইনগুলোকে বাতিল করে পত্রিকায় ছাপানো খবর বা প্রবন্ধ, সাময়িকী, সিনেমা, টেপ রেকর্ডারসহ সব ধরনের অনির্ভরযোগ্য প্রমাণপত্র গ্রহণের এখতিয়ার আদালতের রয়েছে, যা ন্যায়বিচারের পথকে বন্ধ করে দিয়েছে। যখন একজন বিচারকের স্কাইপ কেলেঙ্কারি জনসাধারণের নিকট প্রকাশ পায় তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে এটি মূলত বিচারের নামে প্রহসনের নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়।

২১ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, শুধু আসামিপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আইনটি এরকম ছিল কারণ তারা নিশ্চিত ছিল যে, আদালত অভিযুক্তদের ফাঁসি দেবে। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক নিয়োগ দেয়ার পরও যখন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাকে শুধু যাবৎজীবন কারাদন্ড দেয়া হয় তখন বিচারিক হত্যা নিশ্চিত করার জন্য ধারাটি সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষকেও আপিল করার অধিকার দিয়ে সংশোধনীর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করা হয়, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। তখন বুঝার আর বাকি থাকে না যে, এটি আসলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইনের মাধ্যমে একটি বিচারিক হত্যার আয়োজন ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এর সর্বশেষ শিকার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এ দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ সকল ইসলামী নেতৃবৃন্দ তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

শাহাদাতের পূর্বে মাওলানা নিজামীর দীর্ঘ মোনাজাত :
এরপর আব্বু আমাদের অনুরোধে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করেন। প্রায় ঘন্টাখানেক এই মোনাজাতপর্ব স্থায়ী হয়। আল্লাহর প্রশংসা ও নবী করীম (সাঃ) এর প্রতি দুরুদ পাঠ করার পর প্রথমে প্রায় ২০ মিনিট, রাসূল (সা)-এর শিখিয়ে দেয়া মাসনুন দোয়াগুলো, যেগুলো আব্বুকে সারা জীবন করতে দেখেছি সেগুলো পাঠ করেন।

অতঃপর তিনি বলেন, “হে আল্লাহ আমি তোমার এক নগণ্য গুনাহগার বান্দাহ, তুমি আমাকে যতটুকু তোমার দ্বীনের খেদমত করার তাওফিক দিয়েছো তা মেহেরবানি করে কবুল করে নাও। আমাকে ইসলাম ও ঈমানের ওপর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার তাওফিক দাও আর শাহাদাতের মৃত্যু দান কর। হে আল্লাহ তুমি আমাকে আর আমার বংশধরদেরকে নামায কায়েমকারী বানাও আর আমাকে আমার পিতা-মাতাকে আর সকল মুমিনদেরকে কাল কিয়ামতের দিনে ক্ষমা কর।

হে আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণ ঈমান দান কর, তোমার ওপর সত্যিকারের ভরসা করার তাওফিক দান কর। আমাদের জিহবাকে তোমার সার্বক্ষণিক জিকিরকারী বানাও। আমরা তোমার কাছে, তোমার ভয়ে ভীত অন্তর, উপকারী জ্ঞান, হালাল প্রশস্ত রিজিক, সুস্থ বুদ্ধি ও দ্বীনের সঠিক বুঝ ভিক্ষা চাচ্ছি। হে আল্লাহ আমাদেরকে মৃত্যুর পূর্বে তওবা করার তাওফিক দাও, মৃত্যুর সময় আরাম দান কর, মৃত্যুর পরে তোমার ক্ষমা লাভ করার তাওফিক দাও ও দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর।

হে আল্লাহ তোমার হালালকৃত জিনিসের মাধ্যমে হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দাও, তোমার আনুগত্যের মাধ্যমে তোমার নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দাও আর আমাদেরকে তুমি ছাড়া কারও মুখাপেক্ষী করো না। আল্লাহ তোমার নুর দিয়ে আমাদেরকে হেদায়াত দান কর। আমাদের সকল গুনাহ খাতা তোমার সামনে পরিষ্কার, তোমার কাছেই ক্ষমা চাচ্ছি ও তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করছি। ইয়া হান্নান ইয়া মান্নান।”

তিনি আরো দোয়া করেন, “হে আল্লাহ তুমি এই দেশকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করে নাও, এই দেশের জন্য শান্তির ফয়সালা করে দাও। এ দেশকে গুম, খুন, রাহাজানি ও আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা কর”। তিনি দেশ ও দেশবাসীর সুখ সমৃদ্ধির জন্যও দোয়া করেন। এই আবেগঘন মোনাজাতের সময় আমার মেয়ে কয়েকজন জেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর চোখে পানি দেখেছে বলে পরে আমাকে জানায়।

অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় প্রিয় নেতার বিদায় :
রায় কার্যকরের নির্বাহী আদেশ ১০ মে সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। রাত ১২টা ১০ মিনিটে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মহান রবের পানে চলে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাত ১টা ৩০ মিনিটে কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে শহীদ নিজামীর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রওনা করে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে লাশবাহী বহর পৌঁছে সাঁথিয়ার মনমথপুরে জন্মভূমিতে। সেখানে পূর্ব থেকেই উপস্থিত ছিলেন তার পরিবারের সদস্যগণ ও হাজারো শোকাহত জনতা। শহীদ নিজামীর কফিনবাহী গাড়ির বহর বাড়িতে পৌঁছলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সাধারণ মানুষ তাদের নেতাকে এক নজর দেখার জন্য আকুতি করতে থাকে এবং ঢুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু মানুষের এই কান্না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হৃদয় গলাতে পারেনি, ফলে শেষবারের মত তাদের প্রিয় নেতার মুখ দেখতে পারেনি সাধারণ জনতা। তাদের সমস্বরের কান্নায় মনমথপুরের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। উপস্থিত জন¯্রােত সামলাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হয়।

তারপর কফিনবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িসংলগ্ন মনমথপুর কবরস্থানে। সেখানে পূর্ব থেকেই অপেক্ষমাণ হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে জানাযায় দাঁড়িয়ে যায়। সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত জানাযায় হাজার হাজার মানুষ শরিক হন। জানাযা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা লাশ নিয়ে যায় কবরস্থানে। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সাধারণ মানুষ কবরস্থানে ঢুকে পড়তে চাইলে আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের বাধা দেয়। তাদের বাধা উপেক্ষা করে হাজার-হাজার মানুষ কবরস্থানে প্রবেশ করে। শতবাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দাফনের পর একই স্থানে ২৬ বার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, যা ইতিহাসে বিরল।

দেশে-বিদেশে জানাযা : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর গায়েবানা জানাযা দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এসব জানাযায় লাখ লাখ জনতা অংশগ্রহণ করে। কেন্দ্রীয়ভাবে ১১ মে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে একাধিক গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত তৌহিদী জনতা মাওলানা নিজামীর জন্য চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে তাঁর শাহাদাতের মর্যাদা কামনা করেন। গায়েবানা জানাযা শেষ হওয়ার পর মুসল্লিরা শ্লোগান দিতে দিতে ও ভি চিহ্ন দেখিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যান।

চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দান ও তার সংলগ্ন সড়ক, সিলেটের সরকারি আলিয়া মাদরাসা ময়দান, রাজশাহীর হেতেম খা গোরস্থানসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা, জনপদে গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের বাইরে মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, জেদ্দা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, মিশিগান, ব্রুকলেন, লন্ডনের আলতাব আলী পার্ক, তুরস্কের আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল, ওমান, বাহরাইন, কাতার, মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, কানাডার মন্টিয়াল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, কাশ্মিরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মাগফেরাত কামনায় অসংখ্য গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।