জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছিল। ফলে তাকে কাছ থেকে দেখার ও একসাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের একজন মর্দে মুজাহিদ। অন্যায়ের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন এক সৈনিক। ভয়-ভীতি লোভ-লালসা থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিলেন তিনি।
জনাব আলী আহসান মুজাহিদ পর্যায়ক্রমে জামায়াতের ঢাকা মহানগরী আমীর, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এসব দায়িত্ব পালন কালে তাকে খুবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। খুব সংক্ষেপে তাকে যেভাবে পেয়েছি-
তিনি খুবই সাদাসিধা জীবনযাপন করেছেন। সাধারণ খাবার-দাবার, সাধারণ পোশাকই পছন্দ করতেন। খাবারের সাথে কাঁচামরিচ, আচার-চাটনি দিয়ে বেশ মজা করে চিবিয়ে সময় ধরে খেতেন। গাছগাছড়া ভেষজ দ্রব্যাদির গুণাগুণ সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন এবং তা আমল করতেন।
সাংগঠনিক নিয়মশৃঙ্খলার ব্যাপারে খুবই শক্ত ও কঠোরতা মেনে চলতেন । যে কোনো জটিল ও তুলনামূলক শক্ত ও কঠিন বিষয়গুলো মীমাংসার জন্য তাকেই পাঠানো হতো এবং তিনি তা করতে পারতেন।
তিনি খুবই আমানতদার ছিলেন। সংগঠনের বায়তুলমালকে খুব ভালোভাবে হেফাজত করতেন। সাংগঠনিক জীবনে ও সরকারের মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন সমানভাবে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করে গেছেন।
তিনি খুব সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। সত্যিকারভাবেই শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন এমনই একজন ভয়ডরহীন সাহসী মানুষ। জল্লাদ যখন তাকে জমটুপি পরাতে চাইলেন, তিনি তখন জল্লাদকে বললেন, আমাকে জমটুপি পরানোর প্রয়োজন নাই, জমটুপি তো তাদের জন্য, যারা মৃত্যুভয়ে ভীত। আমার মাঝে মৃত্যুকে নিয়ে কোনো ভীতি নেই। আমি স্থির এবং স্বাভাবিক আছি। শহীদি মৃত্যু আমার আরাধ্য ছিল, আমার লক্ষ্য ছিল। আমি তো সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।
ইনসাফ, নিরপেক্ষতা ও সততাকে তিনি জীবনের সকল ক্ষেত্রে পালন করার চেষ্টা করে গেছেন। দলীয় লোকের ক্ষেত্রেও তিনি একই নীতি অনুসরণ করে গেছেন। নির্লোভ ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সদা সতর্ক থাকতেন।
আলী আহসান মুজাহিদ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা আবদুল আলী ছিলেন বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রখ্যাত আলেম ও কুরআনের মুফাসসির। পিতার কাছেই মুজাহিদের শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। প্রথমে তিনি ফরিদপুরের ময়েজউদ্দিন হাইস্কুলে ভর্তি হন।
ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৬৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। সে সময় ১৯৬৫ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী ছাত্ররাজনীতি করার কারণে দু’বার কারাবরণ করেন তিনি। এরপর আলী আহসান মুজাহিদ ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন ও ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
প্রথমে ঢাকা জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি ও পরে পূর্ব-পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালে মুজাহিদকে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মুজাহিদের পিতা মাওলানা আবদুল আলী জামায়াতে ইসলামী থেকে ১৯৬২ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তাদের আদি বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে। পদ্মার ভাঙনে হরিরামপুরে তাদের গ্রামটি বিলীন হলে তারা ফরিদপুরে যান।
মুজাহিদ ভাইয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুন্সি আহসান কবির বলেন, আলী আহসান মুজাহিদ এই দরিদ্র দেশের একজন মন্ত্রী হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। এমনকি সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি তার সেই মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জনগণের সেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। দরিদ্র এই দেশে যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে অধিকাংশ ব্যক্তিই অনিয়ম আর দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন, সেখানে মুজাহিদের বিরুদ্ধে বিরোধীপক্ষ থেকে সামান্যতমও অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কেউ তুলতে পারেননি।
তার ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর ইবনে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের লিখার মাধ্যমে ও শহীদের বক্তৃতায় জীবনের মজবুত দিকগুলো ফুটে উঠেছে মনে করে তা এখানে উল্লেখ করা হলো-
বর্তমানে পরিত্যক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রজনীগন্ধা সেলের একেবারে ডান কোনায় ৮নং সেলে তিনি, শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ও শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সেই ঘরটিতেই ছিলেন।
তিনি ছোট রুমের মাটিতে জায়নামাজের ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। মাথার নিচে কোনো বালিশও ছিল না।
পরিবারের সদস্যদের দেখে বললেন, ও তোমরা এসেছ। আলহামদুলিল্লাহ-
জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে তো কিছু জানায়নি। তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ। আল্লাহর ওপর কত ভরসা থাকলে সবকিছুকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া যায়।
সকলের সাথে হাত মেলালেন, আলাদা আলাদা করে প্রত্যেককে কাছে ডেকে তার সাথে হাত মিলাতে শুরু করলেন। একে একে সবাই শিকের ভেতর দিয়ে হাত মেলালেন। প্রত্যেকের খোঁজখবর নিলেন। শেষ করে বললেন, কারও সাথে মুসাফাহ করা বাদ যায়নি তো? সকলের হকের ওপর খেয়াল রেখেছেন।
একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি পরিবেশ সামলিয়ে নিয়ে বললেন, কান্নাকাটির দরকার নেই। আমি কিছু কথা বলবো।
মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও তিনি তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে কথা বলতে পেরেছেন। তিনি অত্যন্ত স্বভাবসুলভ কণ্ঠে, মাথা উঁচু করে অনেকটা ভাষণের ভঙ্গিমায় শুরু করলেন, নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, আসসালাতু আসসালামু আলা সাইয়্যেদুল মুরসালীন। ওয়ালা আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাইন।
আম্মা বা’আদ বলে কথা শুরু করলেন আল্লাহ তা’আলার কাছে শুকরিয়া পেশ করে। বিপদের মধ্যেও জেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিলেন যে তারা এই সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন।
হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ, সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না- আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য, আমার পরিবার, সংগঠন ও দেশবাসীর কাছে কাপুরুষ প্রমাণ করার জন্য দিনভর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ক্ষমা চাওয়া মিথ্যাচারের নাটক করা হয়েছে। এই জালিম সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি নির্দোষ, নির্দোষ এবং নির্দোষ। আজ তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করতে যাচ্ছে।
তোমরা শুনে রাখো, তোমরা চলে যাওয়ার পর আজ যদি আমার ফাঁসি কার্যকর করা হয়, তাহলে তা হবে ঠান্ডা মাথায় একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। তোমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে না। তোমাদের কিছুই করতে হবে না। আজ আমার মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর এই অন্যায় বিচারিক প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের বিচার আল্লাহর দরবারে শুরু হয়ে যাবে, বিচার শুরু হয়ে গেছে।
আল্লাহর রহমতে আমি পবিত্র মক্কা নগরীতে ওমরা করেছি অসংখ্যবার। আর হজ করেছি ৭ থেকে ৮ বার। আমার বাবার কবর পবিত্র নগরী মক্কায় জান্নাতুল মাওয়াতে। সেখানে তার কবর উম্মুল মুমেনীন খাদিজার (রা.) পাশে, বেশ কয়েকজন সাহাবীর কবর আছে আলাদা ঘেরাও করা, তার ঠিক পাশে। এখানে অনেক নবী-রাসূলের কবরও আছে। আমি এই পর্যন্ত যতবার ওমরা করেছি, যাদেরই সাথে নিয়েছি তাদের প্রত্যেককেই সেই কবর দেখানোর চেষ্টা করেছি।
সকলকে অসিয়ত করেন- তোমরা নামাজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস থাকবা।
তোমরা সব সময় হালাল রুজির ওপর থাকবা। কষ্ট হলেও হালাল রুজির ওপর থাকবা। আমি ৫ বছর মন্ত্রী ছিলাম, ফুল ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলাম। আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর রহমতে আমি সেখানে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে, পরিশ্রম করে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ আমার ব্যাপারে বলতে পারবে না যে, আমি অন্যায় করেছি। অনেক দুর্নীতির মধ্যে থেকেও আমার এই পেটে (নিজের শরীরের দিকে ইঙ্গিত করে) এক টাকার হারামও যায়নি। তোমরাও হালাল পথে থাকবা। তাতে একটু কষ্ট হলেও আল্লাহ বরকত দেবেন।
আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে মিলেমিশে চলবে। হাদীসে আছে, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। প্রতিবেশীর হক আদায় করবে। আমরা ভাইদের মধ্যে কোনো সম্পত্তি নিয়ে কখনো ঝামেলা হয়নি। তোমরাও মিলেমিশে থাকবে। এসব নিয়ে কোনো সমস্যা করবা না। শান্তির জন্য কাউকে যদি এক হাত ছাড়তেও হয়, তা-ও কোনো ঝামেলা করবে না, মেনে নেবে।
বেশি বেশি করে রাসূল (সা.)-এর ও সাহাবীদের জীবনী পড়বে। আমি জানি, তোমরা পড়েছো, কিন্তু তা-ও বার বার পড়বে। বিশেষ করে পয়গম্বর-এ-মুহাম্মদী, মানবতার বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.), সীরাতে সারওয়ারে আলম, সীরাতুন্নবী, সীরাতে ইবনে হিশাম, রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন, সাহাবীদের জীবনী।
আমি আমার সন্তানদের ওপর সন্তুষ্ট। তোমাদের ভূমিকার ব্যাপারে সন্তুষ্ট।
আইনজীবীদের আমার ধন্যবাদ ও দোয়া বলবে। তাঁরা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাদের ভূমিকার ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট। আইনজীবীরা যেভাবে পরিশ্রম করেছেন, অবিশ্বাস্য। তারা সাহসিকতার সাথে এই আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।
জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবির দুটি বড় নেয়ামত- আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মতো এত বড় নেয়ামত দুনিয়াতে আর একটিও নেই। আমার জানামতে, এই সংগঠন দুটি পৃথিবীর মধ্যে সেরা সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট। গত কয়েক বছরে অনেক নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন, হাজার হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন, আমার মতো জেলখানায় আছেন কয়েক হাজার মানুষ। বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত ৫ বছরে যে ভূমিকা রেখেছে, যে সেক্রিফাইস করেছে, তা অতুলনীয়।
আমার শাহাদাত এই দেশে ইসলামী আন্দোলনকে সহস্রগুণ বেগবান করবে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।
তোমাদের আম্মাকে দেখেশুনে রাখবে। সে আমার চেয়ে ভালো মুসলমান, ভালো মনের মানুষ। এই ব্যাপারে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে তার সম্মানীত শ্বশুর-শাশুড়িকে স্মরণ করেন। শাশুড়ি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, শাশুড়ি তো মায়ের মতোই। আপনি আমাকে যেভাবে স্নেহ করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না।
আমার জানামতে, শহীদের মৃত্যু কষ্টের হয় না। তোমরা দোয়া করবে, যাতে আমার মৃত্যু আসানের সাথে হয়। আমাকে যেন আল্লাহর ফেরেশতারা পাহারা দিয়ে নিয়ে যান।
তিনি পুত্রবধূসহ সকলকে উদ্দেশ করে বলেন, আমি তোমাদের প্রতি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।
মোনাজাতের মধ্যে তিনি জালিমের ধ্বংস চেয়েছেন। আল্লাহ যেন তার রহমতের চাদর দিয়ে তার পরিবারকে ঢেকে রাখেন।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ- জেল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের সাথে আমার কোনো ভুল আচরণ হলে আপনারা আমায় মাফ করে দেবেন। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার সেবকদের তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন এবং তার নিজের পিসির টাকাগুলো সেবকদের প্রয়োজন মাফিক বণ্টন করে দেন এবং সেই ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
দুআ ও সালাম- নিজামী ভাই ও সাঈদী ভাইসহ আরও যারা আছেন, সবাইকে তিনি সালাম পৌঁছে দিতে বলেন। দেশবাসীকে তিনি সালাম দেন এবং সকলের কাছে দোয়া চান। সব শেষে তিনি তার শাহাদাত কবুলিয়াতের জন্য দোয়া করেন। এরপর তিনি সকলের সাথে একে একে হাত মিলিয়ে বিদায় জানান।”
সাধারণ মানুষের অনুভূতি ফুটে উঠেছে সংগ্রাম রিপোর্টার শহীদুল ইসলামের কলম থেকে, তা থেকে কিছু এখানে পেশ করা হলো-
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একজন সত্যিকার অর্থেই মর্দে মুজাহিদ, তিনি আল্লাহর রাহে নিবেদিত একজন পরীক্ষিত সৈনিক। তিনি এই জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য সারাটি জীবন ছিলেন নিবেদিত। এটাই তার অপরাধ! তাই জীবন দিয়ে শিখিয়ে গেলেন কীভাবে হাসতে হাসতে, কলেমা পড়তে পড়তে দৃঢ়পদে ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে যেতে হয়।
ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুরে নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ও মসজিদসংলগ্ন আবদুল আলী ফাউন্ডেশনের জমিতে দাফন সম্পন্ন হয় শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের। একইদিন এক স্থানেই ৫টি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সারাদিন সর্বস্তরের মানুষ এসেছেন প্রিয় নেতার কবর জিয়ারত করতে। অঝোরে কেঁদেছে মানুষ এই প্রিয় মানুষটির জন্য। আল্লাহ যেন তাঁর শাহাদাত কবুল করে নেন, আর তাঁর প্রতি ফোঁটা রক্ত যেন বাংলার জমিনকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজে লাগে।
অশীতিপর এক বৃদ্ধ অঝোরে কেঁদেছেন মুজাহিদের রুহের মাগফিরাতের জন্য। তার চোখের পানি মুখ থেকে গড়িয়ে শ্বেতশুভ্র দাড়ি ভিজে টপ টপ করে পড়ছিল পাঞ্জাবিতে। তিনি কোনোভাবেই কান্না থামাতে পারছিলেন না। কথা বলছিলেন ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে। বলেন, বাবা মুজাহিদকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি, আমাদের সামনেই বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল বিনয়ী। সবসময় মুরব্বিদের সম্মান করতো। তার কথা- যে মানুষটি কখনো কাউকে কষ্ট দেয়নি, যে মন্ত্রী থেকেই কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেয়নি তাঁকেই কিনা ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হলো! এ কেমন বিচার?
পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় ১৫৩-১৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাজের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। এই ধরনের লোকেরা আসলে জীবিত। কিন্তু তার সম্পর্কে তোমাদের কোনো চেতনা থাকে না। আর নিশ্চয়ই আমি ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে এবং যখনই কোনো বিপদ আসে বলে আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে ।” গায়েবানা জানাজায় আসা মানুষের অনেকেই পবিত্র কুরআনের এই বাণীর ভিত্তিতেই বলেছেন, মুজাহিদের মৃত্যু হয়নি। তিনি আল্লাহর কাছে বিরাট মর্যাদা লাভ করেছেন। তার রেখে যাওয়া আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এই হত্যার বদলা নিতে হবে। এই শপথেই বলিয়ান হয়ে তারা বিদায় নিয়েছেন প্রিয় নেতার কবর জিয়ারত শেষে।
পরিবারের সাথে সাক্ষাতে শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ফাঁসি দেয়া হোক আর যাই হোক, বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন চলবে এবং এদেশে ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হবেই- ইনশাআল্লাহ। আর শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা বলেছিলেন, আমার রক্তকে কর্মীরা যেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে লাগায়।
শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও তার সঙ্গী শহীদগণ শহীদি মর্যাদা লাভের মাধ্যমে মূলত এই জমিনে ইসলামের বিজয়ের বীজ বপন করে গেছেন। আজ সে বীজকে বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। মহান রব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে তাওফীক কামনা করছি- শহীদদের প্রকৃত উত্তরসূরি হিসেবে আমরা যেন ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করতে ও ইনসাফভিত্তিক একটি সমাজ কায়েম করতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের প্রিয় ভাই আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ সকল শহীদের শাহাদাত কবুল করুন- আমীন, সুম্মা আমীন।
লেখক : নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।