আব্বুকে ইলেকশনের ঝামেলার মধ্যে রেখে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দশ বছর পরে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আবার ফিরে এলাম আব্বুর কাছে আরেক মহা ঝামেলার মাঝে। ২০১৬ সালের মে মাসের ১১ তারিখে বহুবছর আগে দেখা আব্বুর স্বপ্নটা সত্য হল। আমাকে মহা ঝামেলার এই দুনিয়ায় ফেলে আব্বু আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। মানুষের সাথে মানুষের ব্যাক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি ভাষায় ব্যাক্ত করাটা এমনিতেই কঠিন। আর আমার মত আনাড়ী লেখকের পক্ষে সেটা একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। অনেকেই বলেছেন আব্বুকে নিয়ে কিছু লিখতে, বহু বার চেষ্টা করেছি কিছু লিখব, কিন্তু লিখতে বসলে হাত থেমে যায়, মনের বাস্পে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। আজও যখন লিখছি, চোখের জলেই লিখছি। তাই হয়ত লেখাটা এলেবেলে টাইপের হতে পারে।
সুতরাং পাঠকদের কাছ থেকে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আব্বুর সাথে আমার সম্পর্কটা কিরকম ছিল সেটা কোন দিনও হয়ত আমার পক্ষে সঠিক ভাবে ভাষায় ব্যাক্ত করা সম্ভব হবেন। তিনি ছিলেন আমার পিতা, নেতা, শিক্ষক এবং আরও অনেক কিছু। আব্বু অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন, আমি সেটা পারিনা। কিন্তু আমার আর আব্বুর মাঝে একটা মিল হল আমরা দুই জনেই কম কথা বলার মানুষ। আব্বু কথা না বলেও অনেক কিছু বুঝাতে পারতেন, উনার চোখের একটা ভাষা ছিল, অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তিনি মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকতেন, সেই দৃষ্টি আমাকে ভরসা দিত, প্রেরনা দিত, আরেকটা দিন লড়াই করার সাহস যোগাত। ছোট বেলা থেকেই আমি অল্পতে মন ভেঙ্গে যাওয়া, হাল ছেড়ে দেয়া ছেলে, আব্বুর না বলা চোখের ভাষা, মনের কথা ছোট বেলা থেকে শুরু করে বড় বেলা পর্যন্ত, এমনকি চোদ্দশিকের ওপার থেকেও বারে বারে ঘুরে দাড়াবার শক্তি যোগাত। মনে পড়ে আওয়ামী জুলুমতন্ত্রের বৈরী পরিবেশেও আল্লাহর রহমতে অনেকটা নির্বিঘ্নে জজকোর্ট আর হাইকোর্টে এডভোকেট হিসাবে নিবন্ধিত হলাম। আব্বু জেলে বসেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন আর বললেন, ‘প্রতিদিন শেষ রাতে তোদের সব ভাইবোনের জন্য নাম ধরে দুআ করি’। আমি তো জানতামই আব্বু আমাদের জন্য প্রতিদিন শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুত নামাযের পড়ে দোআ করেন, ছোট বেলায় কতদিন শেষ রাতে আব্বুর কুরআন তেলাওয়াতের শব্দে, অনুচ্চ কান্নামিশ্রিত দোয়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আব্বুর শাহাদাতের সময় তাইতো এই স্বার্থপর আমি আমার কি ক্ষতি হয়ে গেল সেই চিন্তায় ব্যাস্ত ছিলাম। অতি চালাকে ভরা এ দুনিয়ায়, এই বোকাসোকা মোমেনের দিকে কেও আর সেই মায়াভরা প্রশ্রয়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবেনা, রবের কাছে শেষ রাতে উঠে দুআ করবেনা, আমি চলবো কিভাবে? এটাই আমার কাছে তখন বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই কিছু মানুষের অতি প্রত্যাশা আবার কিছু মানুষের ওকে দিয়ে কিছু হবেনা টাইপের আচরন আমার জন্য বেশ ক্ষতির কারন হয়েছে। আমার অংক আর আরবী নাহু সরফের শিক্ষকেরা আমার ব্যাপারে উচ্চ ধারনা পোষন করলেও, ভাষা, সাহিত্যের শিক্ষকেরা, বিশেষভাবে আরবী, ইংরেজী শিক্ষকেরা আমাকে অপদার্থ মনে করত। অতি তোষন, অতি প্রেষন, অতি প্রত্যাশা আর অতি নিরাশার যাতাকলের মাঝে আমার মনে হতো আব্বুই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভাল বুঝতেন। কেও আমার প্রশংসা করলে যেমন তিনি খুব বেশী খুশি হতেন না, ক্ষেত্র বিশেষে অখুশী হতেন, আবার কেও আমার সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বললেও তিনি হতাশ হতেন না। টেবিল চাপড়ে, ঝাড়ি দিয়ে দুনিয়া উল্টে দেয়ার নীতিতে আব্বু বিশ্বাস করতেন না। অপ্রয়োজনীয় নীতি বাক্য দিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করতেননা। মনের কথা আন্তরিকতা দিয়ে, চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। আবার প্রয়োজনে অল্প কথায় যা বলার বলতেন। যখন আমি ফাঁকি দিতাম, আব্বু বুঝতেন, কিন্তু সেভাবে বকা না দিয়ে বলতেন, ‘অভ্যাস খারাপ করিস না’। কেও আমাদের আগ্রহ নিয়ে দেখতে চাইলে বলতেন, ওরা কি প্রদর্শনীর ঘোড়া? ছোটবেলায় আব্বুর বুকটা অনেক চওড়া মনেহত। বুকের উপর কান লাগিয়ে শুয়ে হার্টবিটের শব্দ শুনতে খুব ভাল লাগত। আব্বুর সুঠাম দেহ, সুন্দর চেহারা, তেল দিয়ে আঁচড়ানে ঘন চুল দাড়ি, ভরাট কন্ঠ, মোটা চশমা, সাদা পান্জাবী, শেরওয়ানি, উঁচু টুপি সবকিছুতেই একটা আকর্ষনীয় ব্যাপার ছিল। ক্লাস ত্রিতে পড়া ছোট্র আমি, আব্বুর মত হব বলে যখন মাদ্রাসায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, আব্বু অনেক খুশি হয়েছিলেন, আব্বুর চোখে মুখে খুশীর ঝলক আমার চোখে আজও ভাসে, ঘুরে ফিরে কয়েকবার শুধু একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘তুই কি সত্যি সত্যিই মাদ্রাসায় পড়বি?’ কালের বিবর্তনে আমি বড় হতে লাগলাম আর দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতা যখন একটু বুঝতে শুরু করলাম, হতাশা, নিরাশা আমাকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। আব্বু বিচলিত হতেন না, দরদ নিয়ে বলতেন, “সবকিছু ছেড়ে ভাল আলেম হওয়ার চেষ্টা করতো!” আবার কখন আমার দাদার গল্প, উনার নিজের জীবনের গল্প বলতেন, দাদা তার একমাত্র ছেলেকে আলেম বানাতে চেয়েছিলেন, দোয়া করতেন, আব্বু যেন রাসূল সা: এর ছায়া হয়ে বেড়ে উঠেন, আব্বুর মেধা দেখে লোকেরা আফসোস করত আর বলতো আহারে এত ভাল ছাত্রটা মাদ্রাসায় পড়ে ভবিষ্যত নষ্ট করে ফেলছে! আব্বুও এই সকল কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত হওয়ার উপক্রম হলে দাদা আব্বুর মাদ্রাসায় গিয়ে আব্বুর সামনে উনার শিক্ষককে বললেন, আমার ছেলেকে বলে দিবেন, সে আমাকে কামাই করে খাওয়াক সেটা আমি চাই না, সে আমার একমাত্র ছেলে, আমার যা আছে সেটা দিয়ে তার চলে যাবে, আমি চাই সে যেন বড় আলেম হয়, রাসূলে ছায়া হওয়ার চেষ্টা করে। কখনবা আব্বুর লাইব্রেরীর আরবী বইগুলোর দিকে তাকিয়ে কোন এর বিখ্যাত আলেমের গল্প বলতেন, যার ছেলেরা কেউ আলেম না হওয়ার কারনে শেষ বয়সে তার দুস্প্রাপ্য আরবী বই গুলো মানুষদের মাঝে বিলি করে দিতে হয়েছিল। আবার কখনবা বলতেন উনার আরবী বইগুলোর যে সময়ের অভাবে যত্ন নেয়া হয় না, বেশী পড়া হ্য়না, এই কারনে তারা আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করে কিনা! কখনোবা আরেক বিখ্যাত আলেমের গল্প শোনাতেন, যার ছেলে বাবার মত হতে চাইতো, কিন্তু তিনি বললেন, “বাবা আমিতো আলী রা: এর মত হতে চেয়ে হয়েছি এই আমি, তাই তুমি আমার মতো হতে চেয়ে আর কতই বা বড় হতে পারবে?” ছোট বেলায় কোন একসময় আমার কবিতা লেখার বাতিক উঠল। বিষয়টা আব্বুর তেমন পছন্দ না হলেও তিনি আমাকে সরাসরি কিছু বললেন না। আব্বু আমার ভাইকে বললেন, মোমেন কে বলিস এইগুলোর পিছনে সময় বেশি নষ্ট না করতে, প্রসংগক্রমে আব্বু তখন খালেদকে উনার জীবনের কবিতা চর্চার গল্প বলেছিলেন, আব্বুও ইন্টারমিডিয়েটে (আলিমে) পড়ার সময় কবিতা চর্চা করতেন, কোন কারনে পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট করায় দোষ পড়ল উনার সাহিত্য চর্চার উপর। আব্বুর বড় চাচা এই নিয়ে আব্বুকে বকা দিলে আব্বু উনার লেখা সব কবিতা একটা সুটকেসে ভরে নদীতে ফেলে দেন। আবার কখন আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললে আব্বু বিচলিত হতেন ঠিকই। মনে পড়ে ক্লাস টেনে উঠার পড়ে আমার সদ্য গজানো হালকা দাড়ি শেভ করায় আব্বু বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। সেভাবে কিছু না বললেও বলেছিলেন, তোর চেহারার উজ্জলভাবটা নষ্ট হয়ে গেল। আবার আমার এই কাজের একটা ব্যাখ্যা নিজে নিজেই দাড় করাবার চেষ্টা করতেন, বলতেন, মোমেন হয়ত দাড়ি যাতে ভাল করে উঠে এইজন্য শেভ করেছে। আমি এর পরে আর কোনদিন দাড়ি শেভ করিনি।
সময় গড়িয়ে আমিও বড় হতে শুরু করলাম, আব্বুর চুল দাড়িগুলোও খুব দ্রুত সাদা হয়ে গেল। প্রাকৃতিক নিয়মে আব্বু সাথে দুরত্ব তৈরী না হয়ে কিভাবে যেন উনার আরও কাছে চলে এলাম। এই সময় আব্বু একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে আমার মরহুম দাদা খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছেন আর আব্বু দুর্বল দাদাকে আমার কাছে রেখে হজ্জ্ব করতে চলে গেছেন। এই স্বপ্নের অর্থ সেই সময় বুঝতে না পারলেও আব্বুর শাহাদাতের সময় ঠিকই বুঝতে পেরেছি। যাই হোক বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেল, বড় ভাই পড়তে চলে গেলেন বিদেশে, জমজ ভাইটিও ক্যাডেট কলেজের জীবন শেষ করে বিদেশে পড়তে চলে গেল, ছোট ভাই বেশ ছোট। আমি আর আমার পিঠা-পিঠি ছোট বোনটি হয়ে গেলাম আব্বু আম্মুর হাতের লাঠি। আব্বু মনের দিক দিয়ে সবসময়ই নরম ছিলেন, এই সময় আরও নরম হয়ে গেলেন। আম্মু চাইতেন এই অলস আমি দেশের বাইরে পড়তে যাই। আব্বু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আসলে আমার অন্য ভাইয়েরা তাদের নিজেদের উদ্যোগে স্কলারশীপ যোগার করে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন, এ বিষয়ে আব্বু খুব একটা রাজী ছিলেননা, নিম রাজী ছিলেন। তিনি চাইতেন আমরা সবাই যেন তার আশে পাশে থাকি। আব্বুর প্রশ্রয়ে ২০০১ সালে কামেল পরিক্ষা দেয়া পর্যন্ত আমি আর কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করিনাই। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়টা কঠিনই ছিল। সাংগঠনিক, পারিবারিক, শারিরিক অসুস্থতা সকল কিছু মিলে আব্বু আর আমাদের পরিবারের জন্য ছিল কঠিন পরিক্ষার সময়,।পিঠের ব্যাথায় আব্বু শয়্যাশায়ী হলেন। মরার উপর খরার ঘার মত আম্মুকে উনার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হল। আম্মুর চাকরীই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। বিপদে পরিবারের সবাই কাছাকাছি আসে, আমিও আব্বুর আরও কাছে আসলাম। কম কথা বলা আব্বু, উনার জীবনের অনেক কিছু আমার সাথে শেয়ার করলেন। আব্বু প্রায় বছর খানেক শয্যাশায়ী ছিলেন, এ সময় আমরা এক সাথে অনেক বই পড়তাম, আব্বুর নিয়মিত অযিফাগুলো শিখলাম। একটার পর একটা বিপদ আসতেই থাকলো। আমার টিবি ধরা পড়ল, আব্বুর চোখের ছানির অপারেশন হল, সেখানেও সমস্যা দেখা দিল। বহু চিকিৎসার পরেও শেষ পর্যন্ত একচোখে আব্বু আর ভালভাবে দেখতে পেতেননা। ব্যক্তিগত ভাবে সেই সময়টাকে আমি অনেক কারনে ভূলে যেতে চাইব, কিন্তু সেই সময় আমি আব্বুর জীবনে সবর ও ইস্তিকামাতের যে বাস্তব রূপ কাছে থেকে দেখেছি, উনার থেকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের হাতে কলমে যে শিক্ষা লাভ করেছি, সেটা আর অন্য কোন ভাবে সম্ভব হতো কিনা জানি না।
২০০০ সালে আব্বু জামায়তের আমীর নির্বাচিত হলেন, আর ২০০১ সালে চার দলীয় জোট বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসল। আব্বু আর মুজাহিদ চাচা গুরুত্বপূর্ন ২টি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেলেন। অনেকের কাছে সেই সময়টা বাংলাদেশে জামায়াতের জন্য স্বর্নযুগ বলে মনে হত। কিন্তু আব্বু বলতেন বিপদ আসছে। আব্বুকে উনার নেতাকর্মীরা সেই সময়ের পরিস্থিতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলতেন, ‘আমি যেন পুলসিরাত পারি দিচ্ছি’। এই সময়ের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে এর পটভূমি তথা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের সামগ্রিক ইতিহাসকে বুঝতে হবে। এর বিস্তারিত আলোচনা অন্যকোন সময় হয়ত করা যাবে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে পটভূমিটা এরকম ছিল, কম্যিউনিষ্ট রাশিয়া যখন মুসলিম বিশ্বে আদর্শিকভাবে বিস্তার লাভ করছিল, ইরাক, মিশর সিরিয়া সহ অনেক দেশে বামপন্থীরা একে একে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল, পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা তখন একান্ত বাধ্য হয়েই বামপন্থীদের ঠেকাতে ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্য গড়ে তোলে। সৌদী আরব ও অন্যান্ন আরব রাষ্ট্র সমুহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সারাবিশ্বে ইসলাম পন্থীরা একটা অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম ছিলনা। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী সভ্যতার একমাত্র আদর্শিক শত্রু হয়ে দাড়ায় ইসলাম তথা ইসলামপন্থীরা। ৯০ এর দশকে এই আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ হিসাবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে ২টি ভাবধারার উদ্ভব ঘটানো হয়। একটি হল জংগীবাদ অন্যটি মডারেট ইসলাম। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী মুভমেন্টকে লক্ষচ্যুত করা, ধ্বংস করা। ৯০ এর দশকের পূর্বে যারা আফগানিস্তান বা অন্যান্ন দেশে জিহাদে লিপ্ত ছিলেন, তাদের সাথে মুসলিম দেশ সমুহের ইসলামী মুভমেন্ট সহ অধিকাংশ মুসলিম সরকারগুলোর একধরনের বোঝাপড়া ছিল। মুসলিম দেশ সমুহে এই মুজাহিদ লিডাররা রাষ্ট্রিয় সম্মান লাভ করতেন। ৮০ এর দশকের শেষ দিকে আফগান মুজাহিদ নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বাংলাদেশ সফরের কথা মনে আছে, তাকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তখন এটাও একধরনের বুঝাপড়া ছিল যে, মুসলিম প্রধান রাষ্ট সমুহে ইসলাম প্রতিষ্টার কাজ সেই দেশের রাজনৈতিক নিয়ম মেনেই চলবে। যার কারনে আমরা দেখি ৯০ এর দশকের আগে মুসলিম প্রধান দেশ সমুহে, শুধুমাত্র মিসর ছাড়া, কোথাও জংগীবাদের তেমন অস্তিত্ব ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ করে ৯০ এর দশকে মুসলিম প্রধান দেশ সমুহে জংগীবাদের উথ্থান ঘটে এবং দেশি বিদেশী মিডিয়া সমুহে এদেরকে বিশাল কাভারেজ দেয়া শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম ছিলনা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জংগীবাদের ফাঁদে মুলধারার ইসলামী আন্দোলনকে ফেলা সম্ভব হয় নাই। এর প্রধানতম শিকার হয় মুলত কওমী মাদ্রাসার কিছু সরল সোজা ছাত্র শিক্ষকবৃন্দ। আমি সেই সময়কার মাদ্রাসার ছাত্র হিসাবে দেখেছি, কিভাবে আফগান ফেরত মুজাহিদদের বেশধরে, মাদ্রাসায় বিশাল অংকের ডোনেশনের লোভ দেখিয়ে কিছু ভীনদেশী গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বিভ্রান্ত করত, জংগী ট্রেনিংয়ে উদ্বুদ্ধ করত। আল্লাহর রহমতে জামায়াত ও শিবিরের নেতৃবৃন্দ এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকায় জামায়াত শিবিরের কোন জনশক্তি এই ষড়যন্ত্রে পা দেয় নাই।
ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষচ্যুত করতে পাশ্চাত্য পূঁজিবাদী গোষ্ঠির আরেকটি উদ্যোগ ছিল মডারেট ইসলাম। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ইসলামী মুভমেন্টের একটা অংশ এই ষঢ়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। তাত্বিকভাবে এই মডারেট ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু নীতি নৈতিকতার ব্যাপারে প্রশ্নের অবতারনা করা, বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়তের পশ্চিমা সস্তা স্লোগান গুলোকে ব্যাবহার করা হয়। ২য় পর্যায়ে, ইসলামের সার্বজনীন আদর্শগুলোকে পশ্চিমা মানবাধিকার, বাকস্বাধিনতা, গনতন্ত্র ইত্যাদি আদর্শের সমার্থক হিসাবে প্রচার করা হয়। ৩য় পর্যায়ে এসে বলা হতে থাকে যে, ইসলামের আদর্শগুলোকে ইসলামের নাম না নিয়েও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম স্কলারদেরকে পাশ্চাত্য বিশ্বে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, বিভিন্ন সেমিনার সিম্পজিয়ামের আয়োজন করা হত। দু:খজনক ব্যাপার হোল, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষস্হানীয় ব্যাক্তিত্ব প্রাথমিকভাবে এই ফাঁদে পা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পরিপ্রেক্ষিতে এই চক্রান্তের স্বরূপ যখন তিনি বুঝতে পেরে পাশ্চাত্য শক্তির ইসলামী আন্দোলন বিরোধী ষড়যন্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন, তখন তিনি পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশুলে পরিনত হন, মডারেট ইসলামের অন্যতম পুরোধা হওয়ার পরও এখন উনার পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের জামায়াত ঘরনার ২ জন বুদ্ধিজীবীকে আমেরিকায় ৯০ এর দশকের শুরুর দিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাদের একজনের হাতধরে বাংলাদেশে মডারেট ইসলামের বিস্তার লাভ করে। অপরজন আমেরিকার নেতৃত্বে একটি নতুন বিশ্বব্যাবস্থার সৃষ্টির প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হন, এ ব্যাপারে সংগঠনকে সতর্ক করেন। আব্বু এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন, উনার কলিগদের অনেকে এ ব্যাপারে আব্বুকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিলেও আব্বু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ছাড় না দেয়ার ব্যাপারে সবসময় আপোষহীন ছিলেন। এক্ষেত্রে সংগঠনের মহিলা বিভাগের নেত্রী হিসাবে আম্মুর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে আমিও অল্পবিস্তর আব্বু আম্মুর এই সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিতাম। আম্মু এই দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে অটল থাকার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কারনে ষড়যন্ত্রমুলক ভাবে উনার প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আব্বুর অনমনীয় মনোভাবের কারনে গোলাম আযম চাচার উপর একটি গোষ্ঠির প্রচন্ড চাপ থাকা স্বত্বেও সংগঠনের ভিতরে মডারেট ইসলামের কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নাই। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, একটি দেশের দুতাবাস ও এনজিওর সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে কিছু লোকেকে তারা ঠিকই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়, যার পরিনতিতে আজকে একটি নতুন দলের উদ্ভব হয়েছে যাদের নেতাকর্মীরা একসময় ইসলামের জন্য জীবনদিতে প্রস্তুত থাকলেও এখন দলের কাগজ পত্রে ইসলামের নাম নিশানা পর্যন্ত রাখতে লজ্জা পান।