২৩ অক্টোবর ২০১৪ আসর নামাজ শেষ করে টঙ্গীর একজন পরিচিত ব্যক্তি মাওলানা গোলামুল কুদ্দুসের সাথে আলোচনারত ছিলাম, হঠাৎ তার নিকট একটি ফোনে জানানো হলো সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়েছে, তার জন্য দোয়া করা এবং মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। মাগরিব নামাজ আদায় করে বিদায় নিলাম এবং বাসায় আসার পর নিদ্রারত অবস্থায় রাত ১০টা ৫৫ মিনিটে টঙ্গীর ফকির মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী মো. জসিম উদ্দিন ফোন করে বলেন, ‘জানেন কিনা অধ্যাপক গোলাম আযম ইন্তিকাল করেছেন।’
এরপর থেকে সারারাত যেভাবে কাটার তাই কেটেছে- সে ব্যাখ্যা অবান্তর। তবে ফজর নামাজ পরেই টিভির সামনে বসে প্রথমেই যে ব্যক্তির ছবিটা দেখতে পেলাম তার নাম শাহরিয়ার কবির। তিনি টকশোতে আলোচনা করছিলেন এবং ইসলামে বিভিন্ন দিক নিয়ে ফতওয়া দিচ্ছিলেন। যেমনটি মাঝে মাঝে দিতে দেখা যায় বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে। শাহরিয়ার কবির বলছিলেন, ‘গোলাম আযম শেষ মুহূর্তেও রাজনীতি করে গেলেন, তার বলা উচিত ছিল আমার কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাই। একজন ফেরেশতার মতো মানুষও যদি মারা যায় সেও বলে, আমার যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকে তবে ক্ষমা করে দিবেন। আর গোলাম আযম আরও দু’জন অপরাধী নিজামী ও সাঈদী যেকোনো একজন যেন তার জানাযা পড়ায়- সে অসিয়ত করে গেলেন। এর মধ্যদিয়ে জামায়াতের লোকেরা একটি গ-গোল সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিল করতে পারবে।’ প্রিয় পাঠক আরও অনেক কথা বলেছেন বর্তমান সরকারের এ আস্থাবাজন বুদ্ধিজীবী। একজন মানুষের মৃত্যুর পর এসব বুদ্ধিজীবীর এমন কথা ব্যথিতদের ব্যথা আরও বাড়িয়ে দেয়। তার কথা আমি কোনো গুরুত্ব দেইনি, আমি দেখছিলাম টিভির নিচে উঠা লেখাগুলো কোন চ্যানেল কিভাবে সংবাদটি উপস্থাপন করে। কারণ আমি জানতাম, ২৩ তারিখ অর্থাৎ আল্লাহ যেদিন অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যু ঘটান সেদিন বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম ছিল ‘অতি আওয়ামী লীগ এবং হাইব্রিডদের দ্বারা আক্রান্ত সরকার বেকায়দায়।’
একই দিন অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যু হয়। এবার কি মিডিয়া এ সুযোগ না নিয়ে ছাড়বে? তাই কোন চ্যানেল কিভাবে সংবাদটি উপস্থাপন করছে সেটা দেখার কৌতূহলই ছিল আমার টিভি দেখার মূল কারণ। ওরা যে কি লিখবে আর কি বলবে তা কি আর বুঝতে বাকি থাকার কথা। তবে কিছু লিখার ইচ্ছে না থাকলেও অন্য যারা টিভি দেখছিল তারা ওই বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবিরের ব্যাপারে যে মন্তব্য করছিল এবং আমাকে কিছু লেখার অনুরোধ করছিল সে কারণেই আমার এ লেখা। অধ্যাপক গোলাম আযম সম্পর্কে কিছু লেখার যোগ্যতা নেই এদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর, যেমন তার চৌদ্দগোষ্ঠীকে উদ্ধার করে ছাড়ার যোগ্যতা রাখেন আবার তার পক্ষে যখন কিছু বুদ্ধিজীবী কথা বলেন, তখন মিলিয়ে দেখি দু’শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দিনের চেহারা আর রাতের চেহারা কাদের কেমন তখন পরি বিপদে। আবার যে গোলাম আযম ‘জীবনে যা দেখলাম বলে বিশাল জীবনী লিখেন যার মধ্যে রয়েছে অসাধারণভাবে লেখা, সমাজনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা যা একজন শিক্ষার্থীর জন্যও বিরাট উপকারে আসবে। আমি এখনও একজন ছাত্র রাজনীতি আর সংবিধান নিয়ে কিছু লেখাপড়া করার চেষ্টা করেও অধ্যাপক গোলাম আযমের সে লেখা বই পড়েই শেষ করতে পারিনি। আমি কিভাবে এ মহান ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি। তবে শাহরিয়ার কবির সাহেবকে বলতে চাই। যারা জীবন ভরে মদ গাঁজাসহ সকল প্রকার নেশা করে আর মৃত্যু মুহূর্তে অসিয়ত করাতো দূরের কথা তারা দেখে তাকে হয় বিষাক্ত সাপ বা বাঘে দৌড়াচ্ছে সে অসিয়ত করবে কি করে? আর অধ্যাপক গোলাম আযম মৃত্যু সজ্জায়ও বলে গেলেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যেন আমার জানাযা পড়ান। এক সময়ের জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম আব্বাস আলী খান মৃত্যু মুহূর্তে বলে গিয়েছিলেন “আমার জানাযা যেন অধ্যাপক গোলাম আযম পড়ান। তাই তার মৃত্যুর সময় অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকার বাইরে থেকেও ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে তার জানাযা পড়ান। মাওলানা সাঈদীর বড় ছেলে মৃত্যুবরণ করলে তার ইচ্ছানুযায়ী তার জানাযা পড়ান মাওলানা সাঈদী এবং মতিঝিল বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ এবং আশপাশে যেভাবে লোকে ভরে গিয়েছিল তাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? মাওলানা সাঈদী পেরোলে মুক্তি পেয়ে যে জানাযা পড়ালেন তাতে কি কোনো গন্ডগোল হয়েছে? তবে কেন আপনার মাথায় এমন একটি দুষ্টুমী চিন্তা আসলো। একটা হলো অসিয়ত ঠিক হয়নি অন্যটি জামায়াতের লোকেরা গন্ডগোল করবে। আসল কথা হলো এসব লোক তো আর আপনাদের মতো করে অসিয়ত করতে পারবে না। এবার দেখি মিডিয়ায় প্রথম স্থান অধিকার করলো কারা।
“মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম মারা গেছেন। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে” প্রায় সকল টিভি চ্যানেলের ভাষ্য এমন। “দেশের মাটিতে গোলাম আযমের দাফন করতে দেয়া হবে না, সারাদেশে বিক্ষোভ ৭১ টিভি। “রাজাকার শিরোমণি ৯০ বছরের কারাদ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে মারা গেছেন?” দেশ টিভি। টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ শিরোনাম দেখলে মনে হবে চ্যানেল ৭১ দ্বিতীয় এবং দেশ টিভি ১ম স্থান অধিকার করেছে। যেমনটি চলছে অতি আওয়ামী লীগ আর হাইব্রিডদের চাটুকারীর প্রতিযোগিতা। কেউ কেউ এদের সংবাদ শিরোনাম দেখে মন্তব্য করেছেন, গোলাম আযম এ দেশের নাগরিক তাও আবার জন্মসূত্রে তবে তার দাফন এদেশে হবে না তো কোন দেশে হবে? যারা এ কথা বলে দেশটা কি তাদের বাপ-দাদার? যে গোলাম আযমের ছেলে এদেশেরই সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন সে গোলাম আযমের দাফন এদেশে হবে না তো কোন দেশে হবে? যে গোলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের জি এস ছিলেন, যে গোলাম আযম ভাষা আন্দোলনের শীর্ষ সৈনিক ছিলেন সে গোলাম আযমের দাফন এদেশে হবে না তো কোন দেশে হবে? কিছু লোককে মন্তব্য করতে শোনা গেছে যদি শাহরিয়ার কবিররা মারা যায় তখন যদি ভারতের দালাল বলে তাদেরকে এ দেশে দাফন করা যাবে না বলে কেউ দাবি তোলেন তাও কি এসব টিভি চ্যানেল এভাবে প্রচার করবে? সব শেষে বলা যায়, অধ্যাপক গোলাম আযম একটি নাম, অধ্যাপক গোলাম আযম একটি ইতিহাস। এ মহান ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত। বয়সের বিবেচনায় মহান আল্লাহ স্বাভাবিকভাবেই তার ডাক দিয়েছেন তবে শাহরিয়ার কবির গংদের যেমন আক্ষেপ রয়ে গেলো গোলাম আযমের ফাঁসি হলো না আর আমাদেরও আক্ষেপ রয়ে গেলো আমরা গোলাম আযমকে চিনলাম না।