গত ১৪ আগস্ট রাতে তোপখানা রোডে আমরা মেহেরবা প্লাজায় পেশাগত কাজ করছিলাম। ইতোমধ্যে এশার নামাজের আজান হয়েছে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকাবস্থায় লক্ষ করলাম, আমার চেয়ারটি নড়াচড়া করছে। বুঝতে বাকি রইল না যে, ভূমিকম্প হচ্ছে। আমার ক্লার্ক কামরুল এসে বলল, স্যার বেরিয়ে পড়েন; ভূমিকম্প হচ্ছে; ১৬ তলা ভবনের ১১ তলা থেকে বেরিয়ে পড়া সম্ভব নয় বিধায় ১০ তলায় অ্যাডভোকেট মো: আজাহার উল্লাহ ভূঁইয়ার চেম্বারে নিউজ দেখে নিজ চেয়ারে বসা মাত্র একজন সিনিয়র আইনজীবী মিজানুল হক চৌধুরী (চট্টগ্রাম) আমাকে এসে জানালেন যে, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী শাহবাগের বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে (পিজি) ইন্তেকাল করেছেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট জাতীয় পত্রিকায় (নয়া দিগন্ত) দেখলাম, সাঈদীর মৃত্যু হয়েছে ৮টা ৪০ মিনিটে এবং ভূমিকম্প হয়েছে ৮টা ৫০ মিনিটে। পত্রিকার ভাষ্যমতে, সময়ের ব্যবধান মাত্র ১০ মিনিট।
রাত প্রায় সাড়ে ১০টায় সাঈদী সাহেবের লাশ দেখতে হাসপাতালে পৌঁছলাম, কিন্তু দেখার সুযোগ হলো না। পরিচিত কয়েকজনের সাথে দেখা হলো, দেখলাম, হাসপাতাল ঘিরে হাজার হাজার জনতা, চলছে মুহুর্মুহু স্লোগান ও মিছিল, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। জটলাবাঁধা লোকজন বলাবলি করছিল, সাঈদী সাহেবের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। এটি পাবলিক পারসেপশন হলেও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া ভূমিকম্পের সাথে মৃত্যুর যোগসূত্র স্থাপন করা বা আলোচনার বিষয়বস্তু করা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে এ কথা তো অস্বীকার করা যায় না যে, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় প্রকাশ হওয়ার পর ১৬৭ জনের প্রাণ গেছে। তখনো শুনেছি বিক্ষোভকারীরা নাকি সাঈদী সাহেবের ছবি চাঁদে দেখেছে। এ কথারও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে একজন ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ শোনার পর প্রতিবাদ হিসেবে ১৬৭ জনের আত্মাহুতি ইতিহাসে এটিই প্রথম। পাবলিক পারসেপশন আইন দিয়ে বা বিজ্ঞান দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না, সাধারণ জনগণ যা বিশ্বাস করে সেটি তাদের আত্মবিশ্বাস যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আশি-নব্বই দশক থেকে সাঈদী সাহেবকে চিনি। তিনি তখনো কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি । ওই সময়ে আমি নারায়ণগঞ্জ সিরাতুন্নবী উদ্যাপন কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব কয়েক দফা পালন করি। কয়েক বছর সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আলী আহাম্মদ চুনকা। সাঈদী সাহেবের কুরআনের তাফসির শোনার জন্য নারায়ণগঞ্জস্থ খানপুর চিল্ড্রেন পার্কে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ দেখেছি। তার ওয়াজের সময়সূচি পাওয়া কঠিন ছিল। বহু বছর নারায়ণগঞ্জে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কমিটির সেক্রেটারি ছিলাম, সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক, পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক। তিনি নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে তাফসির করেছেন, সেখানেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার তাফসির শুনেছি। প্রসঙ্গত, পত্রিকায় দেখলাম, মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুতে শোকবার্তা দেয়ায় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সাঈদীপুত্র মাসুদ-বিন-সাঈদীর বর্ণনামতে, ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদী সাহেবকে নিজ বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যুদ্ধাপরাধ মামলা, ধর্মানুভূতিতে আঘাত, ধর্ষণ, গাড়ি পোড়ানো, ছাত্রলীগ নেতা ফারুক খুনসহ মোট ১৩টি মামলায় গ্রেফতার করে ৪১ দিন রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। মা ও পুত্রের জানাজা পড়ানো ছাড়া তিনি আর কারামুক্ত হতে পারেননি। কারাগারে পরিবারের সদস্যদেরও সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি।
কয়েক বছর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার লেখা ব্রোকেন ড্রিমে প্রদত্ত তথ্য এবং সম্প্রতি ফেসবুকে তার দেয়া স্ট্যাটাসে বিচারপতি সিনহা বলেছেন, তার কাঁধে বন্ধুক রেখে সরকার শিকার করেছে। বিচারপতি সিনহার এই বক্তব্য বিচারাঙ্গনে একটি প্রশ্নবিদ্ধ অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। জাতির কাছে শপথ ভঙ্গের অপরাধে তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকতে পারেন। স্মরণযোগ্য যে, দুদকের মামলায় তিনি এখন ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এবং আরো সাজা অপেক্ষমাণ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাঈদী সাহেবের নির্বাচনী এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সুখরঞ্জন বালির মা ও ভাইকে হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে শুনেছিলাম, সুখরঞ্জন বালিকে সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি। এই নিবন্ধটি লেখার সময় দেখলাম, ফেসবুকে এক সাক্ষাৎকারে সুখরঞ্জন বালি বলেছেন, ‘সাঈদী সাহেব রাজাকার ছিলেন না, সাক্ষ্য চলাকালে আমাকে ভারতে আটকে রাখা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘সাঈদী সাহেব দুইবার এমপি থাকাবস্থায় আমরা সুখে-শান্তিতে নিরাপদে ছিলাম।’ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যার ভাই ও মাকে হত্যা করা হয়েছে এবং যার এ মামলায় বাদি হওয়ার কথা তাকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হাজির না করায় সাক্ষ্য আইনের ১১৪ (জি) ধারায় প্রদত্ত বেনিফিট একজন আসামি পেতে পারে কি? দেশের আইনজ্ঞ মহল এ মর্মে কী মন্তব্য করবেন?
মামলার রায় একটি পাবলিক ডকুমেন্ট। এ ডকুমেন্ট নিয়ে আলোচনা বা যুক্তিসঙ্গত পর্যালোচনার অধিকার সব নাগরিকের রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড দেয়ার রায়ের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো: আবদুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি এ এইচ এম শামছুদ্দিন চৌধুরী মানিক মহোদয়দের সমন্বয়ে গঠিত অ্যাপিলেট ডিভিশন বেঞ্চ দীর্ঘ শুনানিয়ন্তে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে প্রদত্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু সাজা বহাল রাখেন। ওই পাঁচজন বিজ্ঞ সম্মানিত বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো: আবদুল ওহাব মিয়া তার প্রদত্ত রায়ে মাওলানা সাঈদীকে ‘নির্দোষ’ বলে মন্তব্য করেন।
এ ধরনের রায় নিয়ে ভবিষ্যতে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, গবেষণা হবে এবং ‘সময়ের সন্ধিক্ষণে সময়ই’ এসব নিয়ে কথা বলবে, গবেষণালব্ধ ফল একদিন প্রকাশ পাবে, সেদিন হয়তো আমরা অনেকে বেঁচে থাকব না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ কত কষ্ট করেছে, কত লাশ নদীতে ভেসেছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে, কত মা-বোন ধর্ষিতা হয়েছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ ধরনের নির্মম কর্মকাণ্ড নিজ চোখে দেখেছি। তবে মাওলানা সাঈদী সম্পর্কে যখন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা উঠে তখন আমার মাথায় কয়েটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, যার কোনো সদুত্তর আমি খুঁজে পাই না। প্রশ্নগুলো নিন্মরূপ-
১. মুক্তিযোদ্ধা সুখরঞ্জন বালির বক্তব্য মতে, বিচার চলাকালীন তাকে কেন ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হলো?
২. সাঈদী সাহেব দু’বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে জোর যার মুল্লুক তার, সে ধারাবাহিকতায় অনেকে পেশিশক্তি ও সরকারি জোর খাটিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু সাঈদী সাহেব যদি জনপ্রিয় না হতেন তা হলে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তার পুত্র মাসুদ বিন সাঈদী নিজ এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন কিভাবে?
৩. সাঈদী সাহেব যদি মানবতাবিরোধী কর্ম করে থাকবেন, তবে নিজ এলাকায় তার জানাজায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিত ও কান্নার রোল পড়ার কারণ কী থাকতে পারে?
৪. সরকারের ভাষ্যমতে, মাওলানা সাঈদী যদি এত বড় নরঘাতক হয়ে থাকেন তবে তার ফাঁসির রায় শোনার পর ১৬৭ জন জীবন বিসর্জন দিলো কোন উদ্দেশ্যে?
এ সব প্রশ্নের সমাধান বা উত্তর এখন সময়ের দাবি। নির্ভেজাল সত্য প্রকাশ হবে- কামনা করি।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]