চে গুয়েভারার বলিভিয়ান ডায়েরি আমি পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই। কলেজ শিক্ষিকা এক আত্মীয়ের টেবিলে দেখে নিয়ে এসেছিলাম। তার আদর্শ ও কৌশলের সাথে একমত হওয়া যায় না। তারপরও আদর্শের প্রতি তার একাগ্রতা, তা প্রতিষ্ঠার জন্য কঠিন সংগ্রাম আসলেই বিরল। কিউবা বিপ্লবের পর চে চাইলে খুব সুখেই জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু ওই যে বিপ্লব রক্তে ঢুকে গিয়েছিল, তা তাকে কিউবাতে স্থির থাকতে দেয়নি। বলিভিয়ায় ছুটে গিয়েছিলেন আরেক বিপ্লবের উদ্দেশ্য। সফল হননি। সেখানে চে আটক হলেন। জীবন মৃত্যুর ব্যবধান এক সুতো। সিআইএ এজেন্টের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে চুপ থাকলেও সর্বশেষ যখন প্রশ্ন করা হলো, এখন কি ভাবছেন? তখন উত্তর না দিয়ে পারেননি। বলেছিলেন, “ভাবছি- বিপ্লবের মৃত্যু নেই।”
মীর কাশেম আলী। তার সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। তবে চেষ্ঠা করেছি। যা বুঝেছি তা হলো আধুনিক বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লবের ব্যাতিক্রমী এক স্বপ্নদ্রষ্টা। আমার রিয়েলাইজেশন সম্পূর্ণ ঠিক নাও হতে পারে। তবে বাংলাদেশে যারা ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন তাদেরকে শুধুমাত্র রাজনীতি, ওয়াজ মাহফিলের ভিতর সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজসেবা, মিডিয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির ভিতর নিয়ে এসে সবকিছুকে ইসলামের আলোকে সাজানোর এক প্রবল বাসনা আছে মীর কাশেম আলী ও তার সমমনাদের।
সফলও হয়েছেন। যা বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন এক ডাইমেনশান সৃষ্টি করেছে। একবার পড়েছিলাম, তুরস্কের নাজমুদ্দীন আরবাকান সবসময় বলতেন, “Turkey is in her way back to Islam” তিনি কাজ শুরু করেছিলেন একটা কফি হাউস দিয়ে। সেটা ছিল এক নতুন কৌশল, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ইস্তাম্বুলে ঐ ক্যাফেটা এখনও আধুনিক তুরস্কের ইসলামি আন্দোলনের সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত। তাকে একবার তার বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন- নাজমুদ্দিন, একটা ফুল দিয়ে আপনি কিভাবে বসন্ত আনবেন? তিনি বলেছিলেন- বসীর, বসন্ত শুরু হয় দুই একটা ফুল ফোটার মধ্য দিয়ে। দেখবেন, তূর্কীতে আবার ইসলামি হুকুমাত আসবেই আসবে। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, “যদি এখনই চাও ইসলামি হুকুমাত কায়েম করতে তাহলে আমরা ব্যর্থ হব। কারণ তখন আমাদের শত্রুরা ভেতর ও বাইরের সব দিক থেকে আঘাত হানবে। আসুন আমরা প্রথমে নিজেদেরকে ইসলামের খাটি অনুসারী করে তুলি, আর দুই একটা করে ইসলামের সৌন্দর্য সমাজে ফুটিয়ে তুলি। আসুন আমরা মানুষকে বুঝাই ইসলামি জীবন বিধানের প্রায়োগিক দিক গুলো। ব্যবসা করে শিখাই ‘ইহাই ইসলামী ব্যবসা নীতি’।” দেখা গেল আধুনিক তুরস্কের ব্যবসা বাণিজ্য তার লোকদের হাতেই এসে গেল। তিনি বলেছিলেন: ‘স্কুল মাদ্রাসা বানিয়ে আসুন সবাইকে দেখিয়ে দিই ইসলামি শিক্ষা কাকে বলে’। ফলে এমন কোন গ্রাম আজ তুরস্কে নেই যেখানে আরবাকানদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল নেই এবং মানের দিক দিয়ে সেগুলো সব চেয়ে ভাল স্কুল। সেখান থেকে পাস করে অন্ততঃ ইসলাম বিদ্বেষী কেউ হচ্ছে না।
মীর কাশেম আলীরা হয়তো সেই কৌশলই নেয়া শুরু করেছিলেন। গতানুগতিক ধর্মীয় ওয়াজের বিপরীতে সর্বস্তরের মানুষের বোধগম্য ভাষায় কুরআনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার কার্যকর পন্থা নিয়েছিলেন মাওলানা সাঈদী। তিনিও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের হাতে আটক। ব্যবসা-বাণিজ্যকে ইসলামীকরণের ব্যাতিক্রমী পন্থায় কাজ শুরু করেছিলেন মীর কাশেম আলী। এখন তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ মামলায় তাকেও আটক করা হয়েছে। অনেক কুসংস্কারের বিপরীতে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মৌলিক ইসলামের আলো ছড়ানোর পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনিও প্রতিহিংসার স্বীকার। আর বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির দিকপালদের তো কারাগারে ঢুকানো হয়েছেই।
যাদের আটক করা হয়েছে তারা সবাই বিদেশে চাইলে খুব ভাল ভাবেই উন্নত জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু ওই যে ইসলামী বিপ্লবের চেতনা রক্তে ঢুকে গিয়েছে সেই চেতনা তাদের দেশ ত্যাগ করতে দেয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা তাদের চুড়ান্ত আঘাত হানা শুরু করেছে। এ অবস্থায় কি আলোর পথে চলা বন্ধ হয়ে যাবে? না, বন্ধ হতে পারে না। বিভিন্ন দেশে এসব কঠিন পথ পাড়ি দিয়েই বিজয় এসেছে। এখানেও আসবে…
পোস্টটি লিখেছিলাম ১৭ জুন ২০১২ সালে এসবি ব্লগে। সেদিন মীর কাশেম আলীকে আটক করা হয়েছিল। আজ উনার শাহাদাত বার্ষিকী। পুরনো লিখাটির কথা তাই মনে পড়ে গেল।