জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞগণ মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- বাতিল করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। একই ধরনের আহবান এসেছে লন্ডন ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইউরোপীয়ন পার্লামেন্টের ৫০ জন সদস্য ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী লর্ড, কার্লাইলের পক্ষ থেকেও।
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে আমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই অধিকার আছে, যেকোন অপরাধের বিচার আমরা করতে পারি। একই সাথে এটাও ঠিক বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে আলাদা নয়। বর্তমান বিশ^ায়নের যুগে বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে একা একা পথ চলা মোটেই সম্ভব নয়। তাছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদের সাক্ষরকারী একটি দেশ। সে কারণেই বাংলাদেশে সংগঠিত যেকোন গঠনারই বিশ্ব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। যা খুবই স্বাভাবিক।
একই কারনেই যুদ্ধাপরাধ বা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ মহলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও মতামত দেয়া হয়েছে। প্রসিকিউশনের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের এই সব উদ্বেগ ও প্রশ্নের ব্যাপারে কোন সন্তোষজনক জবাব দেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ফলে ক্রমেই বাংলাদেশ সরকারের এতদসংক্রান্ত কার্যক্রমের ব্যাপারে আস্থাহীনতা, প্রশ্ন ও উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। বাড়ছে দূরত্বও। এসব বিষয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত কর্তা ব্যক্তিরা যে মোটেই বুঝেন না তা নয়। তারপরও বিষয়টি যে তাদের মনোপুত নয়, সেজন্য অবিরামভাবে তা উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশের বিশেষ শ্রেণীর রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের এ এক অদ্ভুত চরিত্র যে, তারা যখন বিদেশ সফরে যান, তখন বিদেশী কোন রাষ্ট্র প্রধান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের সাথে হাত মিলানো, চায়ের টেবিলে একত্রে বসতে পারা কিংবা কোন ফটোসেশনে অংশ নিতে পারলে নিজেকে অনেক বড় সাফল্যের অধিকারী হিসেবে মনে করেন। তদুপরি, যদি কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে কার্টিসির অংশ হিসেবে কোন প্রশংসাসূচক বাক্য বেরিয়ে আসে তাহলে ঐ ব্যক্তি, তার দল কিংবা দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। অপরদিকে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঐ বিশেষ মহলের আদর্শিক প্রতিপক্ষ কারো ব্যাপারে যৌক্তিকভাবে মিনিমাম সত্য উচ্চারণ করা হয়, তখন ঐ বিশেষ মহলটি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। তখন তারা বলতে থাকে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের উপর হস্তক্ষেপের শামিল। তাদের চোখে তখন ঐ সব সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গ হয়ে যান বিতর্কিত। তারা মিথ্যাচার করতেও কার্পণ্য করেন না। বলতে থাকেন, এই সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ মীর সাহেবের পক্ষে কেন বললেন? তাহলে তারা মীর কাসেমের সাহেব কাছ থেকে পয়সা খেয়েছেন। যারা এসব বাজে কথা বলেন, তারা ভুলে যান তাদের এসব বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদেরকে দেশে ও বিদেশে কতটা উপহাসের পাত্র বানাচ্ছেন। তাদের সেই বোধ শক্তি আছে বলে মনে হয় না! কিন্তু তাদের ব্যাপারটা যাই হোক, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে বিশ্বের মানচিত্রে ছোট হয়, বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হয় এ ব্যাপারে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সরকারকে, যে আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হলো এগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া। মৃত্যুদ- কার্যকরে তাড়াহুড়ো না করে আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষণ, উদ্বেগ ও আহবানকে আমলে নিয়ে তাদের বক্তব্যকে নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করা। কারণ আন্তর্জাতিক মহলগুলো থেকে যৌক্তিক যেসব বক্তব্য এসেছে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উচিত হবে ঐসব সংস্থাগুলোকে আহবান জানানো, তারা যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তার পক্ষে কারণগুলো উপস্থাপন করতে। প্রয়োজনে তাদের প্রতিনিধিদের সাথে সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের আলোচনা করা উচিত। এক্ষেত্রে যদি তাদের দিক থেকে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলো গ্রহণ করে যথাযথ বিবেচনার মাধ্যমে সরকার নিশ্চিত একটি হত্যার দায় থেকে বেঁচে যেতে পারে। আর এখন তো বিচারের পুরো প্রক্রিয়া শেষ। এ পর্যায়ে পুরো বিষয়টা সরকারের হাতে। আর আইনের কোথাও উল্লেখ নেই নির্বাহী বিভাগ কতদিনের ভিতরে তা কার্যকর করতে হবে। সুতরাং সরকার চাইলে সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি ভেবেচিন্তে কাজ করতে পারেন। এখানে আইনের কোন ব্যতয় হবে না।
সচেতন মহল মনে করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবার-পরিজন কখনো এটা চান না যে, তাদের ও তাদের পরিবারের ওপর যে নিষ্ঠুর নির্যাতন হয়েছে, তার জন্য প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত না করে কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তার প্রতিবিধান হোক। এর মাধ্যমে শহীদদের আত্মা কোনভাবেই শান্তি পাওয়ার কথা নয়। সুতরাং যাদেরকে গোটা দুনিয়া সভ্য ও উন্নত বলে স্বীকার করে এবং যারা মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার প্রসঙ্গে সারা দুনিয়া জুড়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে আসার সুনাম অর্জন করেছে, যারা আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার সম্পর্কে অভিজ্ঞ তাদের আহবানকে উপেক্ষা না করে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান পূর্বক মহামান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অবিলম্বে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- স্থগিত করে তাঁকে মুক্তি দেয়া হোক এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। একই সাথে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তার ছেলে ও তার মামলার অন্যতম আইনজীবি ব্যারিষ্টার আরমানকে মুক্তি দিয়ে তার পরিবারকে শঙ্কামুক্ত করা হোক।
মীর কাসেম আলী একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা, তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ বহুমুখী সামাজিক কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নতিতে তার বিরাট অবদান রয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা মীর কাসেম আলী। এই ব্যাংক শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মধ্যে একটি সফল বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নতিতে ভূমিকা রাখাসহ বাংলাদেশের রেমিটেন্সের অন্যতম সেক্টর গার্মেন্টস শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আর এসব শিল্প ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিকদের উল্লেখযোগ্য অংশই ক্ষমতাসীন ঘরানার সদস্য বলে শুনা যায়। তাছাড়া ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে যারা অন্যান্য ব্যবসা করছেন, তাদের বেশির ভাগই ঐ একই ঘরানার লোক বলে জানা যায়। একইভাবে তারই প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে যারা সার্ভিস নিচ্ছেন তাদের পার্সেন্টিস বের করলেও বেরিয়ে আসবে, সাধারণ জনগণের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উপকার লাভকারী ঐ বিশেষ ঘরানার লোকদের সংখ্যা কত?
সুতরাং যার আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ঐ বিশেষ শ্রেণীর লোকেরাই বেশি উপকৃত হয়েছেন, সেই তাঁকেই তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের ভাষায় “মিথ্যা মামলা ও প্রসিকিউশন কর্তৃক সাক্ষীদেরকে প্রলোভনের মাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে” ন্যায় বিচার পাওয়ার যৌক্তিক আশা থেকে বঞ্চিত করে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করবেন! সৎ কর্মের পুরস্কার হিসেবে ঐ মহলের কাছ থেকে এর চেয়ে আর কি বেশি আশা করা যেতে পারে!
এগুলো আসল কথা নয়। আসল কথা হলো, আন্তর্জাতিক দুনিয়া যেসব উদ্বেগের কথা জানিয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে বুঝা, আত্মস্ত করা এবং সেখান থেকে নিজেদের জন্য নেয়ার মতো কিছু থাকলে তা গ্রহণ করে সঠিক ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি। আমি সংশ্লিষ্ট মহলকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার জন্য অনুরোধ রেখে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এ ব্যাপারে তাদের মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা হুবহু তুলে ধরে আমার লেখার সমাপ্তি টানলাম।
আশা করি পাঠকগণ ও সংশ্লিষ্ট মহল এই বিবৃতি ও বক্তব্যগুলো অনুধাবন করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা মীর কাসেম আলীকে হেফাজত করুন এবং তাঁকে আমাদের মাঝে সুস্থ ও সম্মানজনকভাবে ফিরিয়ে দিন। এই মোনাজাত করে শেষ করছি।
***মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড স্থগিত করতে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও ব্যক্তিদের আহ্বান
মীর কাসেমের মৃত্যুদ- স্থগিত ও আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী
পুনঃবিচারের আহ্বান জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডাদেশ রহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে মীর কাসেম আলীর পুনর্বিচারের আহ্বান জানানো হয়েছে। তার রিভিউ শুনানির আগে, তার ছেলে ও ডিফেন্স টিমের সদস্য ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেমকে আটকের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্যাতন, বিনা বিচারে আটক ও জোরপূর্বক অপরহণবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞরা গতকাল মঙ্গলবার জেনেভা থেকে দেয়া এক বিবৃতি এ কথা জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২০১৪ সালে মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদ- দেন। আইসিটির দেয়া রায় গত ৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বহাল রাখেন।
এতে বলা হয়, মৃত্যুদ- প্রয়োগে সুষ্ঠু বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান বজায় না রাখার অভিযোগ রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যা অনুসরণ করতে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ন্যায্য বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় সাজা কার্যকর বিবেচনা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাজা হিসেবে মৃত্যুদ- অতুুৎকন্ঠ। তাই তার প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ।
মীর কাসেম আলীর ছেলে ও তার ডিফেন্স টিমের আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাসেমকে গত ৯ আগস্ট তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ বিশেষজ্ঞ দল। তাদের মতে, মীর কাসেম আলীর রিভিউ শুনানির দুই সপ্তাহ আগে কী সন্দেহ বা অভিযোগে, কাদের দ্বারা এবং কোথায় তার ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। মীর আহমেদ বিন কাশেমের অবস্থান সম্পর্কে অবিলম্বে জানানোর জন্য জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিদাতা বিশেষজ্ঞরা হলেন, মিস এজেন্স চেল্লেমার্ড, মিস. মোনিকা পিন্টু, মি. জোয়ান ই. মিনডেজ, মি. সিটোনডিজেই রোল্যান্ড আডিজুভি।
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বন্ধে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আহ্বান-
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামসের পক্ষ থেকে শুক্রবার এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানানো হয়। ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেকে বিশ্বাস করে মীর কাসেম দোষী এবং তারা তার শাস্তি চায়। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে নিরপেক্ষভাবে। অন্যায্য বিচারের মাধ্যমে দ্রুত মৃত্যুদ- দিলে ভুক্তিভোগীদের কাছে কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।’ এর আগে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকরের আগেও তাদের দ- স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছিল সংস্থাটি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য যে বিচার করছে সেটা ত্রুটিপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মানের ন্যায় বিচার এখানে দরকার।’ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যদি কাসেম আলীর বিচারে এতটুকু সন্দেহের ছায়া থাকে, তবে সেটা বন্ধ করা উচিত।’
মীর কাসেম আলীর মামলায় ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন প্রধান বিচারপিত সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্র্যাড অ্যাডামস দাবি করেছেন, কাসেম আলীর বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়েছে তা ‘অর্ধসত্য’ এবং ‘দায়িত্বহীন’। কাসেম আলীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের মামলা অসঙ্গতিপূর্ণ। ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, চট্টগ্রামে ডালিম হোটেলের নির্যাতনকেন্দ্রে যখন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমউদ্দিনকে হত্যা করা হয় তখন মীর কাসেম ঢাকায় ছিলেন। মীর কাসেমের ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে তার পরিবার ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, তাকে আটক করেনি কোনো বাহিনী। তবে নিউম্যান রাইটস ওয়াচ জামায়াত ও কাসেম আলীর অভিযোগের ভিত্তিতে আহমান বিন কাসেমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, ‘মীর আহমেদ বিন কাসেমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক।’ অ্যাডামস বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করার নজির এটি। সাধারণত কোনো সরকার এটা পছন্দ করে না।’
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিতে অ্যামনেস্টির আহ্বান
মীর কাসেমের ছেলে মীর আহমদের পরিণতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ অ্যামনেস্টির
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকরের কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত মঙ্গলবার নিজস্ব ওয়েবসাইটে এ আহ্বান জানায় এ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি।
অ্যামনেস্টি অভিযোগ করে বলে, অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ কার্যক্রমের মাধ্যমে মীর কাসেমকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তার আসন্ন ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে।
‘বাংলাদেশ : হল্ট ইমিনেন্ট এক্সিকিউশন অব মীর কাসেম আলী আফটার আনফেয়ার ট্রায়াল’ শিরোনামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক চম্পা পাটেল বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য বাংলাদেশের মানুষ বিচার পাওয়ার যোগ্য। মৃত্যুদন্ডের অব্যাহত ব্যবহারের মাধ্যমে সেটা অর্জন হবে না। এভাবে ফাঁসি কার্যকর কেবল অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা বৃদ্ধি করবে এবং সমাজে বিভাজন আরো বাড়বে মন্তব্য করেন তিনি।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- বাতিল করে পুনরায় তার বিচার শুরু করার আহবান জানায়। তার বিচার প্রক্রিয়ায় কিভাবে অব্যাহত অনিয়ম করা হয়েছে তা তুলে ধরেন তারা।
পাটেল বলেন, শুরু থেকেই বিচার প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু বিচার বিষয়টিকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। মৃত্যুদ- একটি নিষ্ঠুর ও অপূরণীয় শাস্তি। যা কেবল বিচার প্রক্রিয়ায় অবিচারের মিশ্রণ ঘটাবে। ১৯৭১ সালে যারা নৃশংসতার শিকার তারা ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়ার চেয়ে ভাল কিছু প্রাপ্য। এই শাস্তির উচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে সমস্ত মৃত্যুদ- কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেমের পরিণতি নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি। গত ৯ আগস্ট গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই আহমেদ কাসেমকে আটক করা হয় বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
চম্পা বলেন, আন্তর্জাতিক গুম দিবসে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অবিলম্বে, পুঙ্খানুপুঙ্খ মীর আহমেদ কাসেম আলীর জোরপূর্বক গুমের তদন্ত করতে হবে।
মীর কাসেমের মৃত্যুদ- স্থগিত করুনঃ হাসিনাকে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের ৫০ জন এমপি
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদ- স্থগিতের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিলেন ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের ৫০ জন এমপি
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি), যা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যে কোন বিচার করবার ক্ষমতা সম্পন্ন একটি দেশীয় আদালত, এর বিচার প্রক্রিয়ার বেআইনি দিকগুলো নিয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে আমরা আপনাকে লিখছি।
আমরা স্মরণ করছি, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহীত একটি রেজ্যুলুশনে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, বিশেষ করে সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদন্ড থেকে অনেক দূরে থাকবার কারণে আইসিটি’র তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, এই আদালত থেকে ইতোমধ্যে ১৭ জন ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে পাঁচ জনের রায় কার্যকর করা হয়ে গিয়েছে।
জনাব মীর কাসেম আলী, যিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী’র একজন নেতা এবং মিথ্যা এবং রাজনৈতিক প্রভাবান্বিত প্রসিকিউশনের একজন ভিকটিম, তাকে ২০১৪ সালের ২রা নভেম্বর মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। অসংখ্য সূত্র বলছে, তার এই বিচারটি সকল আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা এবং উন্মুক্ততার মানদন্ডে ব্যর্থ হয়েছে। এই মামলায় তার রিভিউ পিটিশনের রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ৩০শে আগস্ট। তবে ইতোপূর্বে যেভাবে অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে এবং যথার্থ আইনী প্রক্রিয়ার গুরুতর লংঘনের মাধ্যমে পুরো মামলাটি পরিচালিত হয়েছে, তাতে এই রিভিউ প্রক্রিয়াটিও যে আইনের যথার্থ প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে পরিচালিত হবে, সেটা আমরা বাস্তবিকভাবে ভাবতে পারছি না। বিশেষত রিভিউ পিটিশনের রায়ের সাথে সাথেই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হতে পারে, এমন কিছু সংবাদে আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। জনাব আলীর এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও যথার্থ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণের বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত হবার আগ পর্যন্ত এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করতে আমরা বাংলাদেশের সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে আহবান জানাচ্ছি।
একই সাথে, জনাব মীর কাসেম আলীর পুত্র মীর আহমাদ বিন কাসেম, যিনি তার বাবার মামলার মূল কৌসুলীর ভূমিকা পালন করেন, আমরা তার কথিত অপহরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা জেনেছি যে, তাকে তার বাসা থেকে ৯ই আগস্ট তুলে নেয়া হয়েছিল এবং এরপর তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে তার সন্ধান খুঁজে বের করে তার অবস্থান এবং সুস্থতা নিশ্চিত করতে জোরদার পদক্ষেপ নেবার জন্যে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
ধন্যবাদান্তে
ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের সদস্যবৃন্দ-
হাইডি হৌতালা
ইজাসকুন বিলবো বারাকান্দিকা
মালিন বরক
ফ্যাবিও মাসিমো কাস্ট্যালদো
ফ্যাবিও দে মাসি
স্টেফান ইক
অ্যানা গোমেজ
হ্যান্স ওলাফ হিঙ্কেল
মারিয়া হিউবুক
ইভা জোলি
ইউসো জুরাইস্তি
জ্যুড কিরটন ডার্লিং
স্টেইলস কৌলুগু
মেরহা কিলোনেন
বারন্ড লমেল
উলরিখ লুনাসিক
স্যাবিন লোসিং
লুইস মিচেলস
ম্যারিনা মিচেলস
দিমিত্রিস পাপাদিমৌলিস
কাতি পিরি
মিশেল রিভাসি
লিলিয়ানা রডরিগুয়েজ
ব্রনিস হোপ
হেলমুট শুলজ
মলি স্কট কাতো
বারবারা স্পিনেল্লি
বারট স্টেস
ইভান স্টেফানিক
মারক তারাবেলা
মিগুয়েল আরবান
আরনেস্ট উরতাসুন
ইভো ভাল
ভ্যারি ক্রিস্টিন ভিজিয়েত
জোসেফ উইডেনহোলজার
নেসা চিল্ডার্স
লাউরা ফেরারা
নিনা গিল
মার্টিন হাউসলিং
সুফিয়া ইন টি ভেল্ড
বেনেডেক জ্যাবর
সাজ্জাদ করিম
থমাস মান্
জ্যাবিয়ার নার্ট
সুরায়া পোস্ট
ক্যারোলিনা পানসেট
ম্যারিটজে স্কেক
জরডি সেবেসটিয়া
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত করতে লর্ড কারলাইলের আহ্বান-
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন বৃটিশ হাউজ অব লর্ডস এর সদস্য লর্ড কারলাইল কিউসি। বর্তমান ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার দেয়া বিবৃতিতে মীর কাসেম আলীর সন্তান মীর আহমদ বিন কাসেমের অবস্থান নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
বৃটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান (tobycadman) এর টুইট থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিবৃতিতে তিনি বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল অসঙ্গতি, পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপযুক্ত। আর ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়ার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদন্ডের লংঘন লক্ষ্য করা গেছে। বিবৃতিতে তিনি, প্রধান বিচারপতি ছাড়া মীর কাসেম আলীর আপিলের পুনঃশুনানির জন্য সরকারের দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের কথাও তুলে ধরেন। বিবৃতিতে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।
লর্ড কারলাইল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের চিঠির কথা তুলে ধরে বলেন, তারাও যথাযথ প্রক্রিয়ার ব্যতয়ের কথা জোর দিয়ে বলেছেন। তারা অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ও স্বাধীন তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরে সংযত হওয়ার আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকারের ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার লংঘনের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক ৯ আগস্ট মীর কাসেম আলীর ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। তারা তাকে কোথায় রেখেছে তা স্বীকার করছে না। তিনি আরো বলেন, আসামীর পরিবারের সদস্যদের উপর আক্রমণ একেবারেই অনাকাঙ্খিত এবং মানবাধিকারের সাধারন নিয়মেরও লংঘন। আর মীর কাসেম আলীর সন্তানকে নিয়ে যা করা হয়েছে, তা আরো উদ্বেগজনক, কেননা সে তার পিতার আইনী কৌশলী এবং তাকে তার পিতার রিভিউ শুনানির আগে গুম করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্য মতে, আরো আসামীর সন্তানদেরও গুম করা হয়েছে। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আইন ও রাজনৈতিক চাপের এই নিষ্ঠুরতা আইনের শাসনের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।