২৮ মার্চ ২০১৫ সাল। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে আমি, মাসুদ ভাই এবং দেলোয়ার ভাইসহ আমাদের প্রায় ২ শতাধিক ভাইয়ের অবস্থান। রি-এরেস্টের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত নভেম্বরের ১০ তারিখ আমাকে সহ ১০ জন ভাইকে এখানে পাঠিয়ে দেয়। দেলোয়ার ভাই শুরু থেকে এখানে আছেন। মাসুদ ভাই সম্ভবত আমার ১ মাস পূর্বে এখানে আসছেন। দেলোয়ার ভাই তিতাস বিল্ডিং এর একটি সেলে থাকেন। আমি আর মাসুদ ভাই মেডিকেলে, সাথে আছেন অধ্যাপক জাকির ভাই। আসরের নামাজের পর লকাপে যার যার বেডে বসে পড়ছিলাম। আমি আর জাকির ভাই পাশাপাশি বেডে মাসুদ ভাই একটু দূরে। পড়ায় মনোযোগ থাকলেও পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন বুঝতে পারলাম। তাকিয়ে দেখি মাসুদ ভাই। চেহারা একটু মলিন। উনাকে দেখে উঠে দাড়াচ্ছি আমাকে থামিয়ে দিয়ে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে উনার বেডে চলে গেলেন। চিরকুটের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে খুব পরিচিত লেখা মনে হল। তবে অনেকদিন পর এরকম লেখা হাতে পেলাম। এখানে আমি, মাসুদ ভাই, দেলোয়ার ভাই এবং সাবেক আমীরে জামায়াত (শহীদ নিজামী ভাই) লেখাগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু এ লেখাটি কার তা অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে। এ হাতের লেখা চিঠি অনেক পেয়েছি এখন মনে করতে পারছিনা। সম্বোধনে স্নেহের লেখা দেখে কিছুটা অনুমান করতে পারলাম।
পরম মমতায় স্নেহের ছোট ভাই বলে আমাদেরকে একজনই খুব বেশি বলতেন। তিনি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন কামারুজ্জামান ভাই। সতর্কতার কথা ভুলে গিয়ে এক নিমিষে চিরকুট টি পড়ে নিলাম। কয়েক দিন থেকে মিডিয়াতে উনার রিভিউ নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। এ নিয়ে আমাদেরও মন খারাপ। চিঠিতে আমাদের প্রতি বেশ কিছু পরামর্শসহ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি লিখেছেন, “তোমাদের মতো আমিও আশাবাদী রিভিউতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিবেন। আমি কোন অপরাধ করিনি।“ উনার লেখা পড়তে পড়তে চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চিঠির প্রার্থনার সাথে আমিও দোয়া করলাম। কামারুজ্জামান ভাই মিথ্যা অভিযোগ থেকে মুক্তি চেয়েছেন, শাহাদাত এবং শহীদী মর্যাদা থেকে নয়। কারাগারে অসংখ্যবার কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। শহীদী মৃত্যু কামনার কথা অনেকবার বলেছেন। প্রত্যেকবারই আমাদের বলতেন, “আল্লাহ যেন আমাকে মিথ্যা অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় শাহাদাত থেকে বঞ্চিত না করেন’’।
কারাগারে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ-
২০১৩ সালের ৯ আগষ্ট কাশিমপুর ২নং কারাগারে ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ঘুরাফেরার বিশেষ সুযোগে উনার সাথে দেখা করার সুযোগ পাই। উনি তখন ৪০ সেলে(ফাঁসির) থাকতেন। এমনিতেই ৪০ সেল খুব সংরক্ষিত এলাকা। মাত্র কয়েকদিন হল এখানে আসলাম। এখনো ভাল করে কারাগারকে বুঝে উঠতে পারিনি। পরিচয় যতটুকু জেনেছে তাতেই জেলার পরের দিনেই লক আপ দিয়েছে আরো কঠিন সেলে। যেখানে সারাদিনে ২১ ঘন্টা সেলে বন্দী থাকতে হত। অসুস্থতার কারনে মেডিকেলে এসে ভর্তি হয়েছি। নিয়মের কড়াকড়ি এবং সার্বক্ষনিক নজরদারির কারনে হাসপাতালের বারান্দা থেকেও বের হতাম কম। ঈদ উপলক্ষ্যে একটু শিথিল হলেও আমার জন্য তখনো শিথিল মনে করতে পারেনি। অনেক অনুরোধের পর বিকাল বেলায় উনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ মিলল। একজন কয়েদী আসামী এবং একজন সিআইডি কারারক্ষী কে সাথে পাঠালে ৪০ সেল এলাকার জমাদার আমাদেরকে ঢুকতে না দিয়ে আবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য কেইস টেবিলে এসে সুবেদারের কাছে জেনে তারপর প্রবেশের অনুমতি দিল। তা আবার বললেন বেশিক্ষন যেন না থাকি।
এই সেল সম্পর্কে আগে কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। ইতিপূর্বে কারাগারের অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনলেও ফাঁসির সেলের কথা কেঊ বলেনি। সবাই ফাঁসির আসামী শুনলেই কেমন আতংক লাগে কিন্তু ঢুকার পর যারা এখানে থাকেন তাদেরকে সে রকম মনে হয়নি। সবাই খুব খোশ আমোদেই আছেন। ভাবলাম ঈদের বিশেষ সুযোগের কারনে হয়তো এরকম। কা্মারুজ্জামান ভাইয়ের সেলের সামনে যেতে উনি বসা থেকে ঊঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি এখানে আছি এবং আজকে দেখা করার চেষ্টা করবো গতকাল থেকেই জানতেন। আমাকে ধরে বললেন, “আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, কিছুক্ষণ আগে সাক্ষাতে গিয়েছিলাম ভাবলাম তুমি এসে ফিরে যাও কিনা”। আমাদের সংগঠনের দায়িত্বশীলদের মধ্যে অনেক চিন্তাশীল এবং বিচক্ষণদের একজন কামারুজ্জামান ভাই। ছোট একটা রুমের মধ্যে উনার প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে অনেক বই। বাংলা, ইংরেজি, আরবি অসংখ্য বই এমনভাবে রাখা যেন নাড়াচাড়ায় বাতাসে পড়ে যাবে। রুমের অবস্থা দেখে বুঝলাম উনার সময় কাটে কিভাবে।
আমার, পরিবারের, সংগঠনের সবার খোজ খবর নিলেন। উনার বাসা থেকে আনা খাবারগুলো আমাকে নিজে প্লেটে তুলে খেতে দিলেন। কারাগারে কেমন আছি, গ্রেফতারের পর নির্যাতন করেছে কিনা, দেলোয়ার ভাই (সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি) কেমন আছেন, এখানে আমরা কতজন আছি, মীর কাসেম ভাই, কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন। আমি সব মিলিয়ে বললাম ভাল আছি, মীর কাসেম ভাই এবং মোল্লা ভাইসহ একসাথে নামাজ পড়েছি। প্লেটে তুলে খাওয়ানোর অভ্যাস কামারুজ্জামান ভাইয়ের পুরোনো। ২০০৬ সালে রোজার ঈদের দিন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুর রহমান ভাইসহ আমরা কয়েকজন পল্লবী সাংবাদিক কলোনীতে উনার বাসায় গিয়েছিলাম। আমি তখন মহানগরী পশ্চিমের সেক্রেটারী। সেদিনও দেখলাম উনি আমাদেরকে তুলে তুলে দিচ্ছেন। খাবার শেষে তোমাদের জন্য একটা মজার জিনিস আছে বলে ভিতর থেকে একটা বড় টিনের কৌটা নিয়ে এসে সেটা নিজের হাত এবং বগলের নিছে রেখে বাচ্চা ছেলেদের মত মুঠ করে আমাদেরকে চকলেট উঠিয়ে দিচ্ছেন। অনেক বড় হলেও কামারুজ্জামান ভাইয়ের ভালোবাসায় নিজেদেরকে উনার স্নেহের ছোট ভাই মনে হয়েছে। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের কারনে বাড়িতে ঈদ করতে না পারলেও সেদিন উনার বাসার মুহূর্তটুকু বাড়ির মতোই মনে হয়েছে।
কারারক্ষীর কারনে খুব বেশি কথা বলা যায়নি। তাদের পীড়াপীড়ির কারনে আরো একটু সময় থাকার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ফিরে আসতে হয়েছে। আসার সময় বললাম, “ভাই আমি সভাপতি হওয়ার পর আপনি কারাগার থেকে যে চিঠি পাঠিয়েছেন তা পেয়েছি। আপনার পরামর্শে খুব উপকৃত হয়েছি, কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি”। আমার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। আমি কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার কয়েক মাস পর কারাগার থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে উনি একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। সংগঠন পরিচালন, ছাত্রশিবিরের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করনীয় বিষয় নিয়ে আমাকে লিখেছিলেন। আমার এখনো মনে পড়ে উনি ছাত্রশিবিরকে মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশা পূরণের জন্য ক্যারিয়ার এবং চরিত্র গঠনের জন্য নজর দিতে বলেছেন। সেই চিঠিতে এও লিখেছিলেন আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে এই মিথ্যা অভিযোগ থেকে মুক্তি দিবেন।
আসার সময় আমার মন খারাপ দেখে বললেন, “আমি দাতের চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝে হাসপাতালে যাই, তখন আবার দেখা হবে কথা হবে”। খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে এ আশা নিয়ে ফিরে এলাম। এরপর মাসে ২/৩ বার চিকিৎসার সুবাদে আমার সাথে দেখা হত। প্রত্যেকবারই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় আমার ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতেন আমি আছি কিনা? কখনো ভিতরে ঢুকতেন না। আমি থাকলে বের হয়ে উনার সাথে যেতাম। চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের সীমানা পার করে ফিরে আসতাম। কখনো ১৫/২০ দিন পার হয়ে গেলেও দেখা না হলেও উনার সেবকের মাধ্যমে কিছু খাবার আমার জন্য পাঠিয়ে চিরকুট লিখে দিতেন। কামারুজ্জামান ভাই যখন খোজ খবর নিতেন এবং দিতেন তখন আমার ব্যক্তিগত পারিবারিক থেকে শুরু করে সংঠন, সরকার, বিরোধীদল, জাতীয়, আন্তর্জাতিক কোন খবর বাদ যেতোনা। আমাদের সব দায়িত্বশীলদের কেউ কারাগারে আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকতেন না। অথচ অন্য অনেক দলের বড় বড় নেতাদের বেশ কয়েকজনের সাথে এই স্বল্প সময়ে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। কারাগারে আসার পর উনারা দুনিয়ার সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন। হতাশা ছাড়া নিজের কর্মীদের সান্তনা দেয়ার মত এমন কোন খবর উনাদের কাছে আছে কিনা তাও সন্দেহ।
২০১৩ সালের ১৬ অক্টোবর ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে কারাগারের সাক্ষাৎ এবং ঘুরাফেরার বিশেষ সু্যোগ। ঈদুল আযহার নামাজ শেষে মীর কাসেম ভাই, কামারুজ্জামান ভাই, কাদের মোল্লা ভাই, মাহমুদুর রহমান সাহেব, গিয়াস উদ্দিন মামুন ভাইসহ বসার সুযোগ হল। ঈদের দিনের কারনে আমাদের অন্য ভাইয়েরাও দেখা করে গিয়েছে। এই দিনটি ছিল অনেক বেশি স্পেশাল। বাহিরে থাকা অবস্থায়ও উনাদের সাথে এভাবে বসার সু্যোগ হয়নি। দীর্ঘ সময়ের আলোচনা গল্পে একবারের জন্যও মনে হয়নি আমরা কারাগারে আছি। সবার সাথে আমার বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় দেখা হলেও কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে উনাদের অনেকদিন পর সাক্ষাৎ। এক ফাঁকে জাগরনের শিল্পীরা এসে গান শুনিয়ে গেল। এতবড় মানুষদের প্রানবন্ত আলোচনায় থাকতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হল।
কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে শেষ সাক্ষাৎ-
২০১৪ সালের ২৫ জুলাই, ২৬ রমাজান। আমার সবগুলো মামালার জামিন এবং বের হওয়ার প্রসেস সম্পন্ন করেও রি-এরেস্ট করে মিন্টু রোডে আবার আসতে হল। প্রায় ১৫ দিন আগ থেকেই আমার বের হওয়ার প্রসেস শুরু হয়েছে। বের হওয়ার ব্যাপারে কাউকে বলা হয়নি মীর কাসেম ভাই এবং আজহার ভাই ছাড়া। যাওয়ার আগে ফাঁসির সেলে গিয়ে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে দেখা করে যাব সে সুযোগের অপেক্ষায় আছি। কিছুদিন আগে উগ্রপন্থি কিছু আসামি পালিয়ে যাওয়ার কারনে চলাফেরাও একটু কঠিন। অবশেষে ২৪ তারিখ উনার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি মিলল। কাদের মোল্লা ভাইয়ের পর কামারুজ্জামান ভাইয়ের মামলা এখন আলোচনায়। আমি আর গিয়াস উদ্দিন মামুন ভাই ফাঁসির সেলের দিকে গেলাম। লক হওয়ার অল্প কিছু সময় বাকি এজন্য যে যার লকআপে চলে গিয়েছেন। আমাদেরকে দেখে উনি আশ্চর্য হলেন। বিশেষ করে আমাকে দেখে। সাদা লুঙ্গি এবং সাদা ফতুয়ার উপর নীল ষ্ট্রাইফের কাজ করা কয়েদী পোষাক পরে আছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি কেমন আছ?
অনেকদিন হাসপাতালে যাওয়া হয়না তোমার সাথে দেখা হয় না”। আমি বললাম ভাই আমার জামিন হয়ে গিয়েছে, ‘আগামিকাল আল্লাহ চাইলে চলে যাব”। উনি খুব জোরে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। কয়টা মামলা জিজ্ঞেস করলেন, সেই সাথে আমার মেয়ের বয়স কত এখন, কত বছরে রেখে আসছি জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, “ভাই আপনাদেরকে রেখে যেতে খারাপ লাগছে। উনি প্রতি উত্তরে বললেন, আমাদের জন্য চিন্তা করোনা, তোমাদের বাহিরে থাকা দরকার আছে, আল্লাহর ফয়সালা আমাদের জন্য যথেষ্ট’। কথাগুলো উনি স্বাভাবিকভাবে বললেও আমার চোখ ভিজে গেল। আগের তুলনায় এখনকার পরিবেশ ভিন্ন। বিশেষ করে কাদের মোল্লা ভাইয়ের শাহাদাতের পর আমাদের নেতৃবৃন্দের শাহাদাতের তামান্না আরো বেশী তীব্র। সবাইকে উনার সালাম দিতে এবং দোয়া করতে বললেন। আসার সময় আবার কলাকুলি করে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় দিলেন। আমাদের জন্য দোয়া করবা আল্লাহ যেন আমাদের মর্যাদার মৃত্যু দেন। আমি আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করিনা। আল্লাহ আমাদের একমাত্র ভরাসা”। অনেকটা চোখের পানিতে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম।
কামরুজ্জামান ভাইয়ের শাহাদাৎ-
২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল। আমি তখন কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে। একই জেলে গ্রেফতারের কিছুদিন পর থেকে সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাঈদী ভাই। আমি আছি ২০১৪ সালের নভেম্বরের ১০ তারিখ থেকে। আমার মাস খানেক আগে থেকেই ডঃ মাসুদ ভাই আছেন। রিভিউ খারিজ হওয়ার পর থেকেই আশংকা চেপে বসেছে। প্রত্রিকা, রেডিওর মাধ্যমে উনাকে নিয়ে খবরগুলো শুনতে শুনতে প্রেশার, ডায়েবেটিকস নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে গিয়েছে। সাঈদী ভাই সেলে থাকার কারনে কোর্টে যাওয়া আসা ছাড়া দেখা হয়না। রিভিঊ কার্যতালিকায় আসার পর থেকে কারাগারে আবার কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। এই কারাগার এমনিতেই খুব কঠিন। আমি ও মাসুদ ভাই মেডিকেলে একই ওয়ার্ডে থাকলেও ২ দিন থেকে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তেমন কথা হচ্ছেনা।
যন্ত্রনার তুফান বয়ে যাচ্ছে উভয়ের উপর দিয়ে। প্রত্যেক নামাজের পর নাম ধরে দোয়া করে যাচ্ছি। আমাদের অন্য ভাইদেরকেও করতে বলছি। রিভিঊ শুরু থেকেই আমীরে জামায়াত আমাদেরকে বেশ কয়েকটা দোয়া লিখে পাঠিয়েছেন। সকাল বিকাল খুব পেরেশানীর সাথে খবর নিচ্ছেন। আমীরে জামায়াত কে এত পেরেশান আগে কখনো দেখিনি, বুঝিওনি। ১১ তারিখ দুপরের পর থেকে আমাদের পেরেশানি বাড়তে থাকলো।
কারাকতৃপক্ষ পারিবারিক সাক্ষাতের জন্য খবর দিয়েছেন। মাগরীবের পর থাকে মিডিয়াতে নিশ্চিত সংবাদ আজকে কার্যকর হচ্ছে। মোল্লা ভাইয়ের সময়ের তুলনায় এখন যেন আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। একা ছিলাম মনে হয় ভালই ছিলাম। এখানে মাসুদ ভাইয়ের মলিন চেহারা দেখে আরো বেশি কষ্ট লাগছে। আমাদের কষ্ট এভং নিঃস্তব্ধতায় পুরো ওয়ার্ড ভুতুড়ে হয়ে আছে। এশার নামাজ, রাতের খাবার শেষ করে যে যার মত বেডে বসে নিঃশব্দ পড়ছি। আমার পাশের বেডে অধ্যাপক জাকির ভাই টুকরো টুকরো উনার ২/১ টা স্মৃতির কথা বলছেন আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলছেন।
মাগরিবের পর ২/১ বার মাসুদ ভাইয়ের বেডের কাছে গিয়ে খবর শুনে আসলেও এখন আর শুনছিনা। বারান্দা দিয়ে কারারক্ষীরা কিছু জিজ্ঞেস করলে সংক্ষেপে জাবাব দিয়ে শেষ করছি। ১০টার দিকে মশারি টানিয়ে ভিতরে বসে কোরআন তেলোওয়াত করছি। কিছুক্ষণ পর দেখি মাসুদ ভাই আস্তে করে ডাকছেন। আমি তাকাতেই বললেন, কামারুজ্জামান ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন”। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
রাত তখন প্রায় সাডে ১০টা। অধ্যাপক জাকির ভাইও মশারির ভিতর থেকে বের হয়ে আসলেন। মাসুদ ভাই তখন আমাদের কাছ থেকে গিয়ে জায়নামাজে দাড়িয়েছেন। কিছুক্ষন পর পুরো ওয়ার্ডে আমাদের তিন জনের কান্নার আওয়াজ । পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে আবার সকালে আমি সাঈদী ভাইয়ের কোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথের স্মৃতিগুলো। বিশেষ করে কারাস্মৃতি এবং শেষ সাক্ষাৎ। আজকে সেটি শেষ সাক্ষাৎ হলেও তখন একবারের জন্যও মনে স্থান দেইনি এটা শেষ সাক্ষাৎ।
বার বার সুরা আহযাবের ২৩ আয়াত টি মনে আসতেছিল। সেটিই তেলাওয়াত করে দিন পার করলাম। “ঈমানদারদের মাঝে কিছু লোক তো এমন রয়েছে যারা আল্লাহ তায়লার সাথে (জীবনবাজীর) যে ওয়াদা করেছিল তা সত্য প্রমান করলো, তাদের কিছু সংখ্যক (মানুষ) তো কুরবানী পূর্ণ (করা শাহাদাত লাভ) করলো, আর কেউ এখনো (শাহাদাতের) অপেক্ষা করছে, তারা তাদের (আসল) লক্ষ্য কখনো পরিবর্তন করেনি”।
লেখকঃ সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।