শতাব্দীর ক্ষণজন্মা ইসলামী আন্দোলনের এক অগ্রসেনানী ছিলেন শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সেরা মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। যিনি কুরআন, সুন্নাহ ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। মেধাবীদের সাহসী ঠিকানা শহীদী কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত এক ব্যাতিক্রধর্মী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হিসেবে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন সে আন্দোলনের সিপাহসালারের। তাঁর ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এদেশের মানুষ সমাজ, সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের নানা অসঙ্গতির ইতিহাস জানতে সক্ষম হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লড়াইয়ে তিনি অন্যতম ছিলেন। দেশে-বিদেশে সভা-সেমিনারে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা সেক্যুলার ও বামপন্থীরা ঈর্সান্বিত হয়ে ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে জিঘাংসা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেখান থেকেই শুরু হয় হত্যার পরিকল্পনা। রাজনীতিতে শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাহচার্য লাভ করেছেন ভাষাসৈনিক মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের । বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শীতা অর্জনে খুব অল্প সময়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর।
মূলত যারা আদর্শের লড়াইয়ে পরাজিত তারাই ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চায়। হত্যা, গুম, অপহরণ এবং বিচারের নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরো জামায়াত নেতাদের হত্যার ভিন্ন অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মেধা, যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণাবলী ও নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত হয়েই প্রতিপক্ষরা তাঁকে হত্য করেছে। শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সদালাপী প্রাণপুরুষ।
পৃথিবীর সকল নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ একের পর এক শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাও শহীদ মীর কাশেম আলীকে হত্যা করে।
আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেশপ্রেমীক, প্রতিশ্রুতিশীল ও জনপ্রিয় জামায়াত ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার মাধ্যমে মানবাধিকার, সত্যপন্থা, কল্যাণ, সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতিককে স্তব্ধ করে দেয়ার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। কলুষিত করা হচ্ছে সত্য, সুন্দর, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা আর শালীনতাকে। শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তাঁর দীর্ঘ সাফল্যমন্ডিত কর্ম, বুদ্ধিদীপ্ততা ও লেখনীর মাধ্যমে অবিস্বরণীয় হয়ে থাকবেন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
জন্মগতভাবেই জনাব কামারুজ্জামান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কুমরী কালিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনায় হাতেখড়ি। ১৯৬৭ সালে জিকেএম ইন্সটিটিউশন থেকে ৪টি বিষয়ে লেটারসহ এসএসসি, মোমেনশাহী নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৩ (১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত) সালে ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে কৃতিত্বের সাথে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন।
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক ময়দান, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রাম, গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকতা ও কূটনৈতিক মহলসহ দেশের সর্বত্র একটি আলোচিত নাম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন ব্যাপক পরিচিত। একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে আদর্শ ও ইসলামী রাজনৈতিক ধারা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিগত চার দশক ধরে তাঁর মেধা মনন বুদ্ধি দিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি, কেন্দ্রিয় সেক্রেটারি জেনারেল ও ১৯৭৮-৭৯ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। এই প্রতিভাধর মানুষটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনেক অবদান রেখেছেন। বিশ্ব মুসলিম যুব সংস্থা (ডঅগণ) এবং বাংলাদেশ সরকারের যুব মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে মৌচাক স্কাউট ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক ইসলামী যুব সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে তিনি প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন। তখন থেকেই তার বিস্ময়কর প্রতিভা সবার নজর কাড়ে।
ছাত্রজীবন পরিসমাপ্তির পর শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলা মাসিক ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ও ১৯৮১ সালে তাঁকে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোনার বাংলায় ক্ষুরধার লেখনির কারণে এরশাদের শাসনামলে পত্রিকাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়। ‘সোনার বাংলা’রাজনৈতিক কলাম ও বিশ্লেষণে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দশ বছর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের একজন সদস্য এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম কাতারে। রাজপথে এবং অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি ছিলেন সদা তৎপর।
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ১৯৮১-৮২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা মহানগরী সহকারী সেক্রেটারি, ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল কেন্দ্রীয় প্রচার সেক্রেটারী এবং ১৯৯২ সাল থেকে তিনি জামায়াতের অন্যতম সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কমিটি ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসাবে বিগত স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ১৯৮৩-৯০ পর্যন্ত তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৩-৯৫ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ও বিভিন্ন কমিটির সদস্য এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেক্রেটারি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। চারদলের কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসাবে তাঁর অবদান অবিম্বরণীয় হয়ে থাকবে। ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্য প্রচেষ্টায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এজন্য দলীয় রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন ফোরামে সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি সকল মহলে সাড়া জাগিয়েছে।
রাজনৈতিক ময়দানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলন, গণতন্ত্র ও তার বিকাশ, নির্বাচন, গণমাধ্যম, সমাজ সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর চিন্তা ও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশে অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও তার কৌশল নিয়ে বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সেই বইগুলো পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে। তাঁর সর্বশেষ বই ‘সাঈদ বদিউজ্জামান নুসরী’ সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় বিগত কয়েকমাস ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে যা পাঠক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
যে কথিত অভিযোগে কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে সে অভিযোগের কোন রকম সত্যতা নেই। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামী ও আদর্শিক চেতনার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ। রাজনৈতিক ময়দানে তাঁর অবদান দেশের ইসলাম বিরোধী শক্তির সহ্য হচ্ছে না।
মানব সমাজে আজ মনে হচ্ছে সত্য পন্থীরাই যেন অপরাধী। প্রকৃত অপরাধীরা যেন সাধু!!! জালেমের বিষাক্ত হুংকার মানব সমাজকে কাঁপিয়ে তুলছে। খোদাদ্রোহী দুনিয়া আজ অত্যাচার, নিপীড়ন, প্রতারণা, হঠকারিতা ও দুরধর্ষিতা ও অপরাজনীতির সীমানা ছেড়ে গেছে। নির্যাতিতের করুণ ফরিয়াদে আকাশ বাতাস দলিত মথিত ও তিক্ত-বিষাক্ত। কিন্তুু তারপরও কি সত্য পথের সৈনিকেরা কি ভীত? না, বরং প্রতিটি মুমিন এই বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দেয়াকে নিজের ঈমানী দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেই এগিয়ে চলছে। এই রকম কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে সকল নবী রাসুল (স:) কে। যুগে-যুগে যারাই সেই পদাংক অনুসরণ করবে, তাদের প্রত্যেককেই একই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (সা.) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’ আল্লাহর দ্বীনের দায়ী হিসেবে সারা বাংলাদেশে নয়, বরং ছুটে বেড়িয়েছেন আমেরিকা, ইউরোপ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, পাকিস্তান সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। মিথ্যা কালিমা আর ষড়যন্ত্রের কালো কাপড় কি সেই আলোকচ্ছটাকে আবৃত করতে পারে? যেই শির আজন্ম এক পরওয়ারদিগার ছাড়া কারো কাছে নত হয়নি, ফাঁসির আদেশে সেই শির দুনিয়ার কোন শক্তির কাছে নতি শিকার করতে পারে?
শাহাদাতের পূর্বক্ষণে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের কারাগারে পরিবারের সাথে সাক্ষাতে বলেছেন”আমি চিন্তিত ও বিচলিত নই। তিনি হাসিমুখে সবাইকে বিদায় দিয়েছেন। তিন পরিবারের সবাইকে সময় সৎপথে চলতে ও সত্যের উপর অবিচল থাকতে বলেছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘এটি একটি ভ্রান্ত রায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং যেসব বিচারপতি এ মামলার রায় দিয়েছেন, যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের বিচার আল্লাহ তায়ালা করবেন। নতুন প্রজন্ম একদিন সত্যের উদঘাটন করবে। আমার বিশ্বাস, আমার মৃত্যুর পর এদেশে ইসলামী আন্দোলন আরো জাগ্রত হবে”।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের প্রধান এজেন্ডা হিসেবে গ্রহন করেছে এ জমীন থেকে ইসলামের শিকড় স্বমুলে উৎখাতের। তার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করা হয়েছে এদেশের প্রধান ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দমন করার। এজন্য তারা বেছে নেয় জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, অপপ্রচার, হামলা-মামলা আর কথিত যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র। আইনের সকল নীতি নৈতিকতা বিবেক বুদ্ধি উপেক্ষা করে অত্যন্ত হীন কায়দায় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রতিপক্ষ দমনের এই আয়োজনে প্রকাশ্য মদদ যোগাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। কারণ তারা এদেশের সম্পদ লুন্ঠন ও আধিপত্য বিস্তারের প্রধান বাঁধা মনে করছে এদেশের ইসলামী শক্তিকে। সুতরাং এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় কথিত যুদ্ধাপরাধী বিচারকে। একের পর এক দেশ বিরোধী চুক্তির মধ্যে দেশের জনগনের নিকট এখন তা দিবালোকের মত পরিস্কার হয়ে পড়েছে।
যে আইন মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী, যে আইন সমাজে বিশৃঙ্খলা, জিঘাংসা আর হানাহানির আশংকার জন্ম দেয় সে আইনই কালো আইন। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইন যে একটি কালো আইন তা নিয়ে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। এই আইন দিয়ে কোন ন্যায় বিচার একেবারেই অসম্ভব। যা নিয়ে আজ দেশে-বিদেশে বিতর্কের শেষ নেই। অবশ্য আইন বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন পৃথিবীতে কোন আইন বা ট্রাইবুনাল নিয়ে এর আগে এতো বিতর্ক হয়েছে কিনা?
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কালো আইন ও ক্যাঙ্গারু কোর্ট হিসেবে গ্রীনিজবুকে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড স্থগিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এইচআরডব্লিউ, লর্ড কার্লাইল, লর্ড এ্যাভিবুরীসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র সংস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু আওয়ামীলীগ কোন নীতি নৈতিকতা ও সমালোচনাকে তোয়াক্কা করেনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্যা ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্যা ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন, দ্যা ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচারকাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিতর্ক বাড়বে।”
টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে-‘বাংলাদেশ : ব্রিফিং এ ফরগটেন জেনোসাইড টু জাস্টিস’ শীর্ষক রিপোর্টে আশঙ্কা করা হচ্ছে সরকার তার পরিচিত প্রতিপক্ষ এবং রাজনৈতিক শত্রুদেরকে দমন করতেই এ বিচারকে ব্যবহার করছে। মুলত পৃথিবীর যত জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, প্রায় তার সবকটিই ওহ ঃযব হধসব ড়ভ ষধি তথা আইনের দোহাই দিয়ে। বর্তমান সরকারও আইনের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও আদালতকে ব্যবহার করে সেই অন্যায়টি-ই করছে বে-আইনী ভাবে। এটিও শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে এক প্রকার ধোঁকা। দেশের জনগণ এটি খুব ভালোভাবেই জানে। ইতিহাস সাক্ষী ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে কেউ সফল হয়নি। এবারও হবে না ইনশাআল্লাহ।
পৃথিবীতে নবী-রাসুলগণ সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিসংগত পন্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবানের পর সেখানেও বিরোধীরা বেছে নেয় অন্ধ আবেগ ও উন্মত্ত হিংস্রতার পথ। সৃষ্টি করে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আজো কিন্তু তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। নবী-রাসূল (সা) খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে আজমাঈন শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে নিজেদের ধন্য করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আজোও আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে এই পথে কবুল করবেন তাদের থেকে বেশী সৌভাগ্যের অধিকারী আর কে হতে পারে?
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ভাই ছিলেন জ্ঞানের জগতে এক উজ্জল নক্ষত্র। অনেক সময় তাঁর আলোচনা শুনলে মনে হতো এ যেন এক ভ্রাম্যমান এনসাইক্লোপিডিয়া। আজ অনেক ঘটনায় শুধু স্মৃতি-২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে ছাত্রলীগের গুন্ডারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় নেতা শহীদ শরিফুজ্জামান নোমানীকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদের গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে কামারুজ্জামান ভাই ও আমি রওনা হয়েছি। পথে যতবারই আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছি, ততবারই পিঠে হাত বুলিয়ে জামান ভাই আমাকে সাহস যুগিয়েছেন। বলতেন, রেজাউল তুমি কেন্দ্রীয় সভাপতি, তুমি শক্ত থাকবা- আল্লাহ সহায় আছেন। আজ তিনি নিজেই সেই জমিনে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে শায়িত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে অনেক ঈদেই বাড়ীতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ক্যাম্পাসেই থাকতে হয়েছে নেতা-কর্মীদের নিয়ে। সে এক অভূতপূর্ব আনন্দ। ঢাকায় যত বাসায় ঈদ কাটিয়েছি সব ঈদই আমাদের নেতৃবৃন্দের সাথে বাসায় সাক্ষাত ছিল খুব আনন্দের। শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শহীদ কামারুজ্জামান, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ও শহীদ মীর কাসেম আলীসহ সবার বাসায় গিয়ে হরেক রকমের খাবার গ্রহণ ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিত। মাঝে-মধ্যে সময়ের স্বল্পতার জন্য অনেকের থেকে ছুটিও মিলতো। কিন্তু এর মধ্যে ব্যাতিক্রম ছিল কামারুজ্জামান ভাইয়ের বাসা। নাছোড়বান্দা ছিলেন কামারুজ্জামান ভাই।
সম্ভবত ২০০৭ সালের ঈদের দিন অনেকের বাসায় যেতে রাত গভীর হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারী জেনারেল সাথে আমরা সবাই ক্লান্ত। সবাই বললেন, এত রাতে জামান ভাইকে কষ্ট না দিয়ে আমরা অন্য সময় উনার বাসায় যাব। ফোনে বলার পর তিনি কোন ভাবেই রাজি হলেন না। জামান ভাই বললেন রাত যতই হোক তোমরা আস। আমি অপেক্ষা করছি। কোন অসুবিধা নেই। রাত একটার পরে জামান ভাই এর বাসায় গিয়ে আমরা হাজির। মেহমান ক্লান্ত বটে কিন্তু মেজবান নয়। যাওয়ার সাথে সাথে হাসি মুখে সালাম দিয়ে বললেন, বাসায় সবার মেহমান এসেছে কিন্তু আমার মেহমান না আসলে হয়? আমার মেহমান তো ছাত্রশিবির। এই জন্য রাত যত গভীর হোকনা কেন তোমরা না আসলে আমার ভাল লাগেনা। এই কথাগুলো হাসিমুখে বলছেন আর হরেক রকম খাবার আমাদের প্লেটে নিজের হাতে তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু প্রতি বছর এখন ঈদ আসে কিন্তু এমন নেতৃবৃন্দের আদর, সোহাগ, ভালবাসা আর সাহচর্য থেকে আমরা বঞ্চিত!
আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (আল-বাকারা: ১৫৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, ‘তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অত:পর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
প্রিয় রাসুল (সা) বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।’ (তিরমিযী) রাসূলে খোদা (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে কিয়ামতের দিন সেই আঘাত নিয়েই সে উঠবে আর তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে এবং রং হবে রক্তের মতই, কিন্তু গন্ধ হবে মিশকের মত। (বুখারী ও মুসলিম)
আবু হোরায়রা (রা) অন্য হাদীসে উল্লেখ করেছেন নবী পাক (সা) বলেন, ‘‘কসম সেই সত্তার! মুহাম্মদের প্রাণ যার হাতের মুঠোয়, কেউ আল্লাহর পথে কোনো আঘাত পেলে কিয়ামতের দিন সে আঘাত নিয়ে হাজির হবে। আর সে আঘাতের অবস্থা হবে ঠিক মিশকের মতো” (বুখারী ও মুসিলম)।
শাহাদাত এমন একটি উচ্চ মর্যাদা, যা প্রতিটি ঈমানদারেরই কাম্য। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকেই কেবল এ মর্যাদা দান করেন। শাহাদাত উচ্চ মর্যাদার শ্রেষ্ঠ মডেল। শহীদদের সম্মান ও মর্যাদা আমাদেরকে এই পথে প্রেরনা যোগাবে অনন্তকাল। শহীদদের রেখে যাওয়া আমানত আজ আমাদের প্রতিটি কাজের অনুসঙ্গ। দ্বীনের ঝান্ডা উড়ানোর অসম্পূর্ণ কাজ আমাদের শ্রেষ্ঠকর্ম। সম্পাদিত কর্মের চাইতে অসম্পাদিত কর্মই এখনো অনেক। সারাটি জীবন আমরা যেন এই পথে নিরন্তন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে সে তাওফিক দান কর।
হে আরশের মালিক! তুমি আমাদের এই প্রিয় নেতৃবৃন্দকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দাও। তোমার প্রিয় বান্দাদের জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল কর! হে মাবুদ! আমাদেরকেও তাদের সাথে জান্নাতে থাকার সুযোগ করে দিও, আমিন।
লেখকঃ কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সেক্রেটারি- ঢাকা মহানগরী উত্তর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।