যুগে যুগে ইসলাম বিরোধী শক্তি ধারণা করে আসছে যে, একটি ইসলামী দলের কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করলে আন্দোলন এমনি এমনি থেমে যাবে? কিন্তু ওরা জানেনা শহীদের এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লে সে মাটি কত উর্বর হয়। মানুষ মাত্রেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না। কিন্তু শহীদের মৃত্যু সকল মৃত্যুর চাইতে মর্যাদাশীল। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না। তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পারো না।” ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা জীবন দেয় তাদের মর্যাদা আল্লাহ পাক এভাবেই বর্ণনা করেছেন। মিথ্যা অভিযোগ এনে সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জানকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। ফাঁসিতে ঝোলানোর পর ওরা কেউ কেউ মিষ্টি খেয়েছে, আনন্দ উল্লাস করেছে। তারা বিজয়ী হয়েছে বলে মনে করছে। শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পরাজিত হয়েছেন বলে আনন্দ প্রকাশ করেছে।
কিন্তু মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বীর সিপাহসালারের মতো স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গিয়ে ফাঁসির দড়ি গলায় পরিয়ে নিয়েছেন। পত্রিকায় এসেছে জল্লাদের সাথে তিনি হেসে হেসে কথা বলেছেন। নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে যে নেতা হাসতে পারেন তিনি কখনো পরাজিত হননা, পরাজিত হয় ষড়যন্ত্রকারীরা, মিথ্যাবাদীরা, ইসলামের দুশমনরা। দেশে-বিদেশে কয়েক কোটি মানুষ গায়েবানা জানাজা পড়েছে। কোটি কোটি মানুষ তার জন্য দোয়া করেছে। আমাদের প্রাণ প্রিয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের নামাজে জানাজা যদি বায়তুল মোকাররমে পড়ার অনুমতি দেয়া হতো তাহলে লাখ লাখ জনতার স্রোত দেখা যেতো। অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি কত বড় মাপের নেতা ছিলেন।
’৯২ বছর বয়সে জেলের ভিতরে মৃত্যুবরণ করে প্রমাণ করেছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা কখনো আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করে না। তার মৃত্যু শাহাদাতের মৃত্যু। অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজায় লাখ লাখ লোক দেখে ফ্যাসিস্ট সরকার এমনভাবে ভয় পেয়েছে যে, কামারুজ্জামান ভাইয়ের জানাজায় মানুষ যাতে হাজির না হতে পারে সে জন্য বাধা দিয়েছে। এমনকি লাঠি চার্জও করেছে। কিন্তু তারা কি ঠেকাতে পেরেছে। তার গ্রামের বাড়ির প্রথম নামাজে জানাজায় পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি জনগণকে কাছে আসতে দেয়নি।
তালিকা তৈরি করে ডেকে ডেকে অল্পসংখ্যক লোককে জানাজায় অংশ নিতে দিয়েছে। কিন্তু সূর্য ওঠার সাথে সাথেই জনতা কোনোকিছুকে তোয়াক্কা না করে দলে দলে কবরের সামনে চলে এসেছে। বিশাল জানাজা হয়েছে। তারা কবরে এক মুঠো মাটি দিয়ে অঝোরে কান্নাকাটি করেছে। দলীয় নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠেছে। জনতার স্রোত দেখে পুলিশ, র্যা ব ও বিজেবির গুলি চালানোর সাহস হয়নি। ফেসবুকে পোস্ট করা ছবিগুলো দেখলেই বুঝা যায় মানুষ তাদের প্রিয় নেতার জন্য কিভাবে কান্নাকাটি করছে। নিজের চাকরির ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে একজন গ্রাম পুলিশ আল্লাহর নিকট দু’হাত তুলে কামারুজ্জামান ভাইয়ের জন্য দোয়া করেছে ও কেঁদেছে। যারা জনসম্মুখে কাঁদতে পারেনি তারা নিরবে নিভৃত্বে কেঁদেছেন। সর্বস্তরের জনগণের চোখের পানিতে আগামী দিনে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল হয়েছে।
জনাব মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ভাই এত তাড়াতাড়ি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন তা ভাবতে পারিনি। ইসলামী আন্দোলনের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসাবে শহীদ কামারুজ্জামানের সঠিক মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় একত্রে কাজ করার সুবাদে অতি কাছ থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সে সম্পর্কে পাঠকদের নিকট কিছু স্মৃতিচারণ করতে চাই। শহীদ কামারুজ্জামান ভাই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সোনার বাংলায় লেখা তাঁর কলাম দারুন পাঠক প্রিয়তা পেয়েছিল। নানা ব্যস্ততার মাঝে কোনো কোনো সময় লিখতে পারতেন না। তখন আমরা বার বার অনুরোধ করতাম লিখার জন্য। পত্রিকাটিতে তার কলাম না থাকলে যেন অপূর্ণাঙ্গ মনে হতো। তিনি এতই যোদ্ধা লেখক ছিলেন যে, তাঁর লেখার জন্য পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন হতো না। কলম ধরলেই যেন লেখা বেরিয়ে আসতো। তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন।
স্বাধীনতাউত্তোর সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তাঁকে স্টেটমেন্ট লেখার দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি বাইরের নিরিবিলি পরিবেশে যেতেন না বৈঠকে বসেই লিখে ফেলতেন। সোনার বাংলা পত্রিকায় তাঁর কক্ষে দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নিজ এলাকা শেরপুরের সাধারণ মানুষ, অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সর্বশ্রেণীর লোকদের আগমন ঘটতো। পত্রিকার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন হলে আমাদেরকে পরে আসতে বলতেন, অথবা খুব ব্যস্ততা থাকলে বলতেন, তোমরা চালিয়ে নাও। তিনি খুবই ভদ্র এবং উদার মনের মানুষ ছিলেন। ফলে যে কোনো ধরনের লোক তাঁর কাছে আসতে পারতো। ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের নেতারা তাঁর কাছে প্রায়ই আসতেন। তিনি বড় ইসলামী দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিল না। তিনি তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতেন। চা-নাস্তা করাতেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ ছিল অতুলনীয়। এক কথায় বলা যায় তিনি শুধু জামায়াতের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন জনগণের নেতা।
তিনি সহজেই লোকদের আপন করে নিতে পারতেন। এমনকি বছরের পর বছর জেলে বন্দী আছে এমন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোকেরাও জেল খানায় তাঁকে সম্মান করতেন।
ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুবরণে কে না ভয় পায়। কিন্তু জেলসূত্রে পত্রিকায় যে সব খবর এসেছে তাতে জানা যায় তিনি খুবই স্বাভাবিক ছিলেন। দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। নিজে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেছেন। জল্লাদের সাথে হেসে কথা বলেছেন। তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ‘জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ, প্রেসিডেন্ট নয়’। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তার রক্তের বদলায় বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন একদিন সফল হবেই। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করুন। পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে তাঁর নিজের হাতের লেখা চিঠি অনুযায়ী পরিবারের সদস্যরা জীবন-যাপন করবেন এই দোয়াই করি।
শহীদ মরে না, এই ঘোষণা আমার নয়, স্বয়ং আল্লাহর। তাই আজ যতবার শহীদ কামারুজ্জামানের মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ততবারই মনে পড়ছে “এসেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
লেখকঃ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।