বাংলাদেশের বিচার বিভাগ যে রাজনৈতিক মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখছে না। আজ মীর কাসেম আলী সাহেবের বিরুদ্ধে আনা ১৪টি অভিযোগের মাত্র একটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আসুন আমরা সেই অভিযোগের একটু পোস্টমর্টেম করি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মোট অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ১৪ টি। এর মধ্যে ১০ টি অভিযোগে মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল তাকে সাজা দেয় এবং এর মধ্যে ১১ নং ও ১২নং অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আজ আপিল বিভাগের রায়ে ১২ নম্বর অভিযোগে তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয় এবং আরও ২টি থেকে তাকে অব্যাহতি ও খালাস দেওয়া হয়েছে।
আসুন দেখি কি ছিল ১১নং অভিযোগ?
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১- মুক্তিযোদ্ধা জসিম কখন কোথায় মারা গেছেন তারও কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে হত্যা ঘটনার তারিখ ও সময় উল্লেখ করা হয়নি। তা ছাড়া জসীম উদ্দিন ছাড়াও অপর পাঁচজনের নাম-পরিচয়ও পাওয়া যায়নি।
২- রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসীমকে ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর ডালিম হোটেলে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগ আনা হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহ উদ্দিন তার ‘প্রামাণ্য দলিল মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন জসীম কবে কোথায় শহীদ হয় তা জানা যায়নি। অথচ এটাই ছিল তাদের অকাট্য ডকুমেন্ট!!
৩- ঘটনার সময়ে অভিযুক্ত মীর কাসেম আলী ঘটনাস্থলে ছিলেনই না। মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে চট্টগ্রামে গেছেন বা ছিলেন সে মর্মে একটি ডকুমেন্টও দেখাতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। তদন্ত কর্মকর্তাও ট্রাইব্যুনালে এটা স্বীকার করে বলেছেন তাদের কাছে এ মর্মে কোনো ডকুমেন্ট নেই।
এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি প্রসিকিউশন টিমকে বলেন ‘আপনাদের ডকুমেন্টেই দেখা যায় ঘটনার সময় মীর কাসেম আলী ঢাকা ছিলেন’। এমনকি রাষ্ট্রপক্ষের জমা দেয়া ডকুমেন্টও তার সাক্ষ্য বহন করছে।
৪- জসিম উদ্দিন হত্যার বিষয়ে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে তার বোন সাক্ষ্য দিয়েছেন যিনি স্বীকৃত পত্রিকার সম্পাদক। অথচ স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে তার নিজের পত্রিকাতেও কখনও তিনি জসিম হত্যায় মীর কাসেমের জড়িত থাকার কথা বলেননি। অথচ তিনি এখন এত বছর পরে এসে ঘটনার রগরগে বর্ণনা দিচ্ছেন যা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। তিনি শপথ নিয়ে আদালতে মিথ্যা কথা বলেছেন। সুতরাং তার সাক্ষ্য কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করা যায় না।
৫- মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট শফিউল আলমের লেখা বই প্রসিকিউশন মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ডকুমেন্ট হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু ওই বইয়ের কোথাও মীর কাসেম আলীর নাম নেই। ডালিম হোটেলের ঘটনায় তার জড়িত থাকার কথাও বইয়ের কোথাও বলা হয়নি। নিহত জসিম উদ্দিনের ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই হত্যাকান্ডে মীর কাসেম আলী জড়িত থাকলে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
৬- চট্টগ্রামের দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এবং আবু তাহের খান মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, মইত্যা গুণ্ডা, কিছু রাজাকার এবং বিহারি মিলে ডালিম হোটেল নিয়ন্ত্রণ করত। তারাই এখানে সংঘটিত সকল অপকর্মের জন্য দায়ী। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের তিনজন সাক্ষীও জেরায় স্বীকার করেছেন তারা মইত্যা গুণ্ডার নাম শুনেছেন।
৭- এ হত্যা ঘটনার সাথে মীর কাসেম আলী সরাসরি বা ঘুরিয়ে পেচিয়ে জড়িত এ রকম একটি রেকর্ড বা প্রমাণও রাষ্ট্রপক্ষ দেখাতে পারেনি। সম্পূর্ণ অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তাকে মৃত্যুদন্ডের সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়েছে। এটি বিচারিক হত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রায় বাংলাদেশের বিপর্যস্ত ও নতজানু বিচার বিভাগের প্রমাণ হয়ে থাকবে এবং বিচারিক ইতিহাসের কলঙ্ক হয়ে থাকবে।
সাক্ষীদের বক্তব্যে ভয়াবহ গরমিল:
১- ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের ছয়জন সাক্ষী ও অ্যাডভোকেট শফিউল আলম লিখিত ‘সেই সময় আনন্দ বেদনায়’ বইটির ওপর নির্ভর করেছেন মীর কাসেম আলীকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রপক্ষের যে ছয়জন সাক্ষী এ অভিযোগ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা কেউ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন, বরং সবই শোনা সাক্ষী। সাক্ষীরা সবাই বলেছেন অ্যাডভোকেট শফিউল আলম ও অন্য কয়েকজনের কাছ থেকে তারা এ ঘটনার বিষয়ে শুনেছেন। কিন্তু অ্যাডভোকেট শফিউল আলম তার বইয়ে ডালিম হোটেলকেন্দ্রিক হত্যা নির্যাতনের ঘটনা বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে কোথাও মীর কাসেম আলীর নাম উল্লেখ করেননি।
২- মীর কাসেম আলীকে তিনি কোথাও ‘খান’ বা ‘খান সাহেব’ বা ‘বাঙ্গালী খান’ হিসেবেও উল্লেখ করেননি। অথচ ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীকে ‘খান সাহেব’ হিসেবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রেও অ্যাডভোকেট শফিউল আলমের বই এবং দুইজন সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছেন।
৩- রাষ্ট্রপক্ষের ১৭ নম্বর সাক্ষী হাসিনা খাতুন তার জবানবন্দীতে বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তার মধ্যে আমার ফুপাতো ভাই জসীম ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন। সে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। জসীম আমাদের চট্টগ্রাম শহরের ব্যাপারীপাড়ার বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। জসীম যখন আমাদের বাসায় আসত তখন তার সাথে অনেক সহযোদ্ধা থাকত এবং ঈদের দিনেও মনসুর নামে এক সহযোদ্ধা তার সাথে আমাদের বাসায় এসেছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি খুব অস্থিরচিত্তে বিভিন্ন জায়গায় জসীমের খোঁজ করতে থাকলাম। এরই একপর্যায়ে বোস ব্রাদার্সের কাছে মতিন বিল্ডিংয়ে অবস্থিত তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে গিয়ে ন্যাপ নেতা অ্যাডভোকেট শফিউল আলম সাহেবের সাথে দেখা করি এবং যখন তাকে জসীমের নিরুদ্দেশের কথা বললাম তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই জসীমের বাড়ি কি সন্দ্বীপে?’ আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে বললাম, জসীম আমার ফুপাতো ভাই, তার বাড়ি সন্দ্বীপ। তখন অ্যাডভোকেট শফিউল আলম সাহেব বললেন, ‘তিনি ডালিম হোটেলে আটক থাকা অবস্থায় জসীমকে ওই হোটেলের একই কক্ষে যেখানে তিনিও আটক ছিলেন সেখানে নিয়ে জসীমকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আল-বদরের সদস্যরা নির্যাতন করে ফেলে দেয়।
শফিউল আলম সাহেব আরো বলেন, তখন কক্ষটি বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং তার চোখ বন্ধ ছিল। জসীমকে ফেলে দিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর অনেক কষ্টে নিজের চোখের বাঁধন আলগা করে জসীমকে মরণাপন্ন অবস্থায় দেখতে পান এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই জসীম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ কথা শোনার পর আমি কান্নাকাটি করছিলাম তখন শফিউল আলম সাহেব আমাকে জনৈক সাইফুদ্দিন খানের কাছে যেতে বললেন। তার কথামতো আমি সাইফুদ্দিন খানের কাছে গেলে তিনিও একই ধরনের কথা বলেন। আমি জসীমের লাশটি কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আপনারা তার লাশটি পাবেন না কারণ তাকে হত্যা করার পর তার মৃতদেহটি কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে’। আমি যখন সাইফুদ্দিন খানের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি এসব বিষয় কি করে জানলেন তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি যখন ডালিম হোটেলে আটক ছিলাম তখন স্বপন নামে একটি ছেলে ডালিম হোটেলে আটক বন্দীদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করত, সে আমাকে এসব তথ্য প্রদান করেছে’। শফিউল আলম সাহেবও অনুরূপ বক্তব্য আমার কাছে বলেছিলেন। …
৪- হাসিনা খাতুনসহ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে ১১ নম্বর অভিযোগ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাদের নাম উঠে এসেছে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের কাউকেই হাজির করেনি।
৫- সাক্ষী হাসিনা খাতুনের বর্ণনা মতে, জসিমের সাথে মনসুর নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তার বাসায় আসত। মনসুর এখনো জীবিত। সেই হতে পারত জসিমের হত্যা বিষয়ে সবচেয়ে ভালো সাক্ষী। কিন্তু তাকেও আনা হয়নি। হাসিনা খাতুন স্বীকার করেছেন: ‘ঈদের দিনে জসীমের সাথে মনসুর নামে যে সহযোদ্ধা আমাদের বাড়িতে এসেছিল সে আমার আত্মীয়, সে রেলওয়েতে অডিট বিভাগে কর্মরত আছেন।
৬- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অ্যাডভোকেট শফিউল আলম তার ‘সেই সময় আনন্দ বেদনায়’ বইয়ে ডালিম হোটেলকেন্দ্রিক কোনো নির্যাতনের ঘটনায় কোথাও মীর কাসেম আলীর নাম উল্লেখ করেননি। অথচ সাক্ষী হাসিনা খাতুন দাবি করেছেন: ‘আমি আমার জবানবন্দীতে যে শফিউল আলম সাহেবের কথা বলেছি তার লেখা ‘সেই সময় আনন্দ বেদনায়’ বইটির জসীম সংশ্লিষ্ট অংশ আমি পড়েছি। আমার চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়ায় সম্পূর্ণ বইটি পড়তে পারিনি। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে ওই অংশে আল-বদর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলীর নাম উল্লেখ আছে।’
এটা সর্বৈব মিথ্যা কথা। এই রকম মিথ্যুক সাক্ষী কিভাবে আদালত গ্রহণ করতে পারে?
৭- স্বাধীনতার পরপরই সাক্ষী হাসিনা খাতুন স্থানীয় ‘সাপ্তাহিক স্বীকৃতি’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি জেরায় স্বীকার করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি অনেক লেখালেখি করেছেন। এমনকি কিলিং স্পট নামে তিনি লিখেছেন। অথচ তিনি স্বীকার করেছেন ডালিম হোটেল বা ফুফাতো ভাই জসীম উদ্দিন বিষয়ে কোনো লেখা লেখেননি।
কেন? এখন এই বিষয়টা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো। এই বিষয়ে তিনি রগরগে বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন অথচ স্বাধীনতার পরে তার লিখা বহু আর্টিকেলের মধ্যে একটিতেও মীর কাসেম আলী সাহেব নিয়ে লিখেন নি। ডালিম হোটেল নিয়ে লিখেন নি।
৮- জসীম উদ্দিনের ভাই প্রফেসর রাজিব হুমায়ূন জীবিত। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তা দাবি করেছেন তার সাথে তিনি কথা বলেছেন। অথচ তিনি তাকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির করেননি। সাক্ষী হাসিনা খাতুন বলেছেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
মীর কাসেম আলীর আইনজীবী এডভোকেট শাহজাহান বলেন, প্রফেসর রাজিব হুমায়ূন কোর্টে সাক্ষ্য দিতে না আসার মধ্যে অনেক সত্য লুকিয়ে আছে। তার ভাই হত্যায় যদি সত্যিই মীর কাসেম আলী জড়িত থাকতেন তাহলে তিনি কোর্টে আসতেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন তিনি বৃদ্ধ। অথচ তিনি বলতে পারেননি তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসরে গেছেন কি না। কাজেই তার দাবি সত্য নয় বলে ধরে নেয়া যায়। তিনি তার জবানবন্দী রেকর্ড করতে পারতেন এবং তা গ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারতেন। মূলত ডালিম হোটেলকেন্দ্রিক নির্যাতনের ঘটনা এবং তার ভাই হত্যার সাথে মীর কাসেম আলীকে তিনি জড়াননি বলেই তাকে আনা হয়নি মর্মে আমরা ধরে নিতে পারি। কারণ তিনিই হতে পারতেন এ অভিযোগের পক্ষে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী।
৯- অ্যাডভোকেট শফিউল আলম তার ‘সেই সময় আনন্দ বেদনায়’ বইয়ে উল্লেখ করেছে, তাকে ২৭ নভেম্বর আটক করে ডালিম হোটেলে নেয়া হয়। অথচ ১৬ নম্বর সাক্ষী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, তিনি ২৩ নভেম্বর অ্যাডভোকেট শফিউল আলমকে দেখেছেন ডালিম হোটেলে আটক অবস্থায় অন্যদের সাথে। জাহাঙ্গীর আলম আরো দাবি করেছেন, তিনি ২৩ অথবা ২৪ নভেম্বর সৈয়দ এমরানকে ডালিম হোটেলে দেখেছেন। অথচ সৈয়দ এমরান দাবি করেছেন তাকে ডালিম হোটেলে আনা হয় ৩০ নভেম্বর। জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন তিনি ২৪ নভেম্বর জসীমকে ডালিম হোটেলে দেখেছেন; অথচ চার্জে এবং অন্যান্য তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে জসীমকে ২৮ নভেম্বর ডালিম হোটেলে আনা হয় এবং সে দিনই তার মৃত্যু হয়।
১০- মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহ উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর। তিনি ‘প্রামাণ্য দলিল মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ শীর্ষক বই লিখেছেন। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরও সদস্য। তিনি বইয়ের ২০১ পৃষ্ঠায় ‘সন্দ্বীপ উপজেলা, বধ্যভূমি ও শহীদদের তালিকা শিরোনামে লিখেছেন জসীমের মৃত্যুর তারিখ এবং স্থান সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
১১- ১৭ নম্বর সাক্ষী বলেছেন, ‘শফিউল আলম সাহেব আরো বলেন, তখন কক্ষটি বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং তার চোখ বন্ধ ছিল। জসীমকে ফেলে দিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অনেক কষ্টে নিজের চোখের বাঁধন আলগা করে জসীমকে মরণাপন্ন অবস্থায় দেখতে পান এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই জসীম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।’
কাজেই জসীমকে কে রুমে ফেলে যায় এবং কে মীর কাসেম তা তখন তার পক্ষে চেনা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। দুই নম্বর সাক্ষী সানাহউল্লাহ চৌধুরী দাবি করেছেন অ্যাডভোকেট শফিউল আলম মীর কাসেম আলীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে বলেছেন তিনি বাঙ্গালী খান। এটা যে মিথ্যা তার কারণ হলো অ্যাডভোকেট শফিউল আলম তার বইয়ে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি।
খান সাহেব বিতর্ক:
এটা ষড়যন্ত্রকারীদের একটা জঘন্য প্রচেষ্টা। তারা ঐ সময়ের কিছু অপরাধীর নাম কে জামায়াত নেতাদের নাম বলে প্রচার করে অভিযুক্ত করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। যেমন আবদুল কাদের মোল্লা কে বিহারী কসাই কাদের আবার দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে রাজাকার দেলোয়ার শিকদার বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছিল। সেই রকমই একটা প্রচেষ্টা মীর কাসেম আলীকে “খান সাহেব” বলে চালিয়ে দেয়া।
১- মীর কাসেম আলীকে রাষ্ট্রপক্ষ ‘খান’, ‘খান সাহেব, ‘বাঙ্গালী খান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়েও মীর কাসেম আলীকে ‘খান’, ‘খান সাহেব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মীর কাসেম আলীকে খান সাহেব হিসেবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল-২ ও ১৯ নম্বর সাক্ষী এবং রাষ্ট্রপক্ষ সরবরাহকৃত ‘সেই সময় আনন্দ বেদনায়’ বইটির ওপর নির্ভর করেছেন। ২ নম্বর সাক্ষী বলেছেন, ‘একপর্যায়ে ছেলেটিকে আমাদের রুমে ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। তখন অ্যাডভোকেট শফিউল আলম কানে কানে আমাকে বলে যে, ইনি মীর কাসেম আলী, বাঙ্গালী খান বদর বাহিনীর কমান্ডার।’
অথচ শফিউল আলম তার বইয়ের কোথাও মীর কাসেম আলীকে ‘খান’ বা ‘খান সাহেব’ হিসেবে উল্লেখ করেননি। এমনকি তার পুরো বইয়ের কোথাও মীর কাসেম আলীর নামই উল্লেখ করা হয়নি। বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে ও তখন মীর কাসেম আলী একজন পরিচিত ব্যক্তি এ দেশে।
২- শফিউল আলম বইয়ের ২৫৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আবার হঠাৎ বুটের আওয়াজ কানে এলো। মনে হলো বেশ ক’জন ক্রমশ নিকটতর হচ্ছে। সেন্ট্রি দরজা খুলে হাঁক দিলো, ‘খান সাহেব এসেছে, সকলে উঠে দাঁড়াও।’ বাইরে থাকতে শুনেছিলাম এ ‘খান সাহেব’ ভয়াল নিষ্ঠুর শক্তিধর এক লোক।’
এডভোকেট শাহজাহান বলেন, এখানে বর্ণিত খান সাহেব এবং বুটের আওয়াজ থেকে এটা পরিষ্কার যে, এই খান সাহেব হলো কোনো পাকিস্তানি আর্মি অফিসার। কারণ ১৬ নং সাক্ষী জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ডালিম হোটেলের দুষ্কৃতকারীরা উর্দুতে কথা বলত। “প্রথমে আমাকে ডালিম হোটেলের বারান্দায় বসিয়ে পিঠে ও ঘাড়ে ২-৩ টা লাথি মেরে এবং বলে ‘শালা বহুত মজবুত হ্যায়’…..”।
ডালিম হোটেল নিয়ন্ত্রণ করত পাকিস্তান আর্মি ও বিহারিরা। কাজেই এখানে বর্ণিত খান সাহেব মীর কাসেম আলী নন এবং লেখক বইয়ে মীর কাসেম আলীকে খান সাহেব হিসেবে উল্লেখ করা তো দূরের কথা, বইয়ের কোথাও তার নামই উল্লেখ করেননি।
বিচারিক হত্যার উৎসবে মেতে উঠা ভারতীয় সমর্থনে গঠিত স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকার এবং তাদের দলীয় পরিচয়ে প্রমোশন পাওয়া বিচারকরা মীর কাসেম আলী সাহেবকে মাত্র একটি অভিযোগে ফাঁসী দিয়েছে। সেই অভিযোগেরই এত দুর্দশা, বাকীগুলোর অবস্থা সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন।
সব অভিযোগ সম্পর্কে জানুন
অন্যান্য জামায়াত নেতার বিচার নিয়ে প্রহসন
মীর কাসেম আলীর ওয়েবসাইট
ফেইসবুক পেইজ
টুইটার
এই অন্যায় বিচার বিভাগীয় রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সবাই সর্বোচ্চ সোচ্চার হোন।